মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় ও জগদীপ ধনখড়।
মুখ্যমন্ত্রীর সৌজন্যের প্রতিক্রিয়ায় রাজ্য সরকারের বিরুদ্ধে বিষোদগারই জারি রাখলেন রাজ্যপাল। তাঁর নয়া অভিযোগ, রাজভবনে দায়িত্বপ্রাপ্ত রাজ্যের পদস্থ অফিসারদের দিয়ে ‘নজরদারি’ চালানো হচ্ছে। তাঁর এ সব অভিযোগ নস্যাৎ করে রাজ্যপালকে ‘অর্ধ-শিক্ষিত, অশিষ্ট এবং গণতন্ত্রের জবাইকারী’ বলে তীব্র পাল্টা আক্রমণ করেছে তৃণমূল।
স্বাধীনতা দিবসের চা-চক্রে যোগ দেবেন না বলে শনিবার দুপুরের মধ্যেই রাজভবনে গিয়ে ঘণ্টাদেড়েক রাজ্যপাল জগদীপ ধনখড়ের সঙ্গে কথা বলে এসেছিলেন মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। তার পরেই বিকালের চা-চক্রে মুখ্যমন্ত্রীর অনুপস্থিতি নিয়ে একের পর এক কটাক্ষ করতে শুরু করেন রাজ্যপাল। ওই অনুষ্ঠানে মুখ্যমন্ত্রীর জন্য রাখা চেয়ারের ছবি দিয়ে টুইটে তিনি লেখেন, ‘‘ফাঁকা চেয়ার অনেক কথা বলে দিচ্ছে। একটা অনভিপ্রেত পরিস্থিতি সৃষ্টি করা হল, যা বাংলার সমৃদ্ধ সংস্কৃতি এবং মনোভাবের সঙ্গে মেলে না। এই অশোভন অবস্থানের কোনও যুক্তি নেই।’’ রাজভবনের অনুষ্ঠানে না গিয়ে সংবিধানের সঙ্গে দূরত্বের আরও একটি নজির মুখ্যমন্ত্রী তৈরি করেছেন বলেও তোপ দাগেন রাজ্যপাল। রাজভবনে রবিবার প্রাক্তন প্রধানমন্ত্রী অটলবিহারী বাজপেয়ীর মৃত্যুবার্ষিকীর অনুষ্ঠানেও রাজ্যপাল শনিবারের ঘটনার উল্লেখ করে ফের অভিযোগ করেন, সাংবিধানিক রীতি মানেননি মুখ্যমন্ত্রী। ‘নজরদারি’র অভিযোগও তোলেন সেখানেই। রাজনৈতিক পর্যবেক্ষকদের অভিমত, মুখ্যমন্ত্রী রাজভবনে গিয়ে কথা বলে আসায় সে আবহ তৈরি হয়েছিল, রাজ্যপালের ধারাবাহিক প্রতিক্রিয়ায় সেই পরিবেশ নস্যাৎ হয়ে গিয়েছে।
সূত্রের খবর, রাজভবনে শনিবার আলোচনায় মমতা জানিয়ে এসেছিলেন, ধনখড় যে ভাবে প্রতিনিয়ত মুখ্যমন্ত্রী, পুলিশ-প্রশাসনের বিরুদ্ধে আক্রমণাত্মক মন্তব্য করেন, তা রাজ্যপাল পদের কাছে শোভনীয় বা প্রত্যাশিত হচ্ছে না। এমনকি, মুখ্যমন্ত্রী এ-ও বলেছিলেন, সরকারের সমালোচনায় রাজ্যপাল যেমন তৎপর, কেন্দ্রের কাছে রাজ্যের পাওনা আদায়ে সেই তৎপরতা দেখালে তা বরং রাজ্যের পক্ষে মঙ্গলের হবে।
ওই আলাপচারিতার সময়েই রাজভবনের শীর্ষ আধিকারিকদের ভূমিকা নিয়ে মুখ্যমন্ত্রীর কাছে পাল্টা অভিযোগ জানান রাজ্যপাল। সূত্রের খবর, ধনখড়ের ক্ষোভের কারণ, রাজ্যের যে অফিসারেরা রাজভবনে দায়িত্বে রয়েছেন, তাঁরা রাজভবনের বদলে সরকারের প্রতি বেশি ‘অনুগত’। মুখ্যমন্ত্রী অবশ্য পাল্টা যুক্তি দিয়েছিলেন, যাঁরা রাজ্যের অফিসার, তাঁরা রাজ্যের প্রতি এবং যাঁরা কেন্দ্রের অফিসার, তাঁরা কেন্দ্রের প্রতিই বিশ্বস্ত থাকবেন, এটাই স্বাভাবিক।
আরও পড়ুন: ‘কোভিড ১৯-এর মৃত্যুহার এখনই বলা সম্ভব নয়’
কিন্তু বিষয়টি যে রাজভবন খুব সহজে নেয়নি, তার ইঙ্গিত মিলেছে রবিবার। ‘নজরদারি’র অভিযোগ এনে রাজ্যপাল এ দিন বলেছেন, তাঁদের অগোচরে রাজভবন থেকে নথি বাইরে বেরিয়ে যাচ্ছে। প্রশাসনিক মহলের মতে, এই অভিযোগের সূত্রপাত রাজভবনে চা-চক্রের অতিথি তালিকা নিয়ে। যেখানে প্রায় ৯০ জন আমন্ত্রিতের নাম ছিল। কিন্তু উপস্থিতির সংখ্যা ছিল ৩৫। রাজভবনের উষ্মার কারণ, দীর্ঘ ওই তালিকা কেন প্রকাশ্যে চলে এল?
অনুষ্ঠানে মুখ্যমন্ত্রীর না যাওয়া নিয়ে যে জটিলতা তৈরি হয়েছে, তাতে রাজ্য প্রশাসনের ব্যাখ্যা, চা-চক্র প্রোটোকল বা সাংবিধানিক বাধ্যবাধকতার সঙ্গে যুক্ত নয়। লোকসভায় তৃণমূলের সচেতক কল্যাণ বন্দ্যোপাধ্যায়েরও বক্তব্য, ‘‘এই রাজ্যপাল অর্ধ-শিক্ষিত, অশিষ্ট এবং গণতন্ত্রের জবাইকারী! মুখ্যমন্ত্রীর সৌজন্যের মর্ম তাঁর মস্তিষ্কে ঢোকেনি! কারণ, মস্তিষ্কটা তিনি বিজেপির কাছে বিক্রি করে দিয়েছেন!’’ রাজভবনে নজরদারির অভিযোগ প্রসঙ্গেও কল্যাণবাবু পাল্টা বলেছেন, ‘‘রাজ্যপাল যাঁর প্রায় গৃহভৃত্যের কাজ করেন, সেই অমিত শাহই গোটা দেশে সর্বত্র নজরদারি চালাচ্ছেন!’’
গাঁধীঘাটের অনুষ্ঠানে গিয়েও শনিবার রাজ্যের আইনশৃঙ্খলার প্রশ্ন তুলে সুষ্ঠু ভাবে নির্বাচন হওয়া নিয়ে সংশয় প্রকাশ করেছিলেন রাজ্যপাল। মন্ত্রী পার্থ চট্টোপাধ্যায় সে দিনই বলেছিলেন, নির্বাচন দেখভাল করা রাজ্যপালের দায়িত্ব নয়। সুজন চক্রবর্তীর মতো বিরোধী নেতারা অবশ্য মনে করেন, রাজ্যের সাম্প্রতিক নির্বাচনের নানা ঘটনা মাথায় রেখে রাজ্যপালের ওই উদ্বেগ সঙ্গত।