অন্য ৬১টি উচ্চশিক্ষা প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ও সম্পূর্ণ স্বশাসন পাওয়ায় মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় খুশি। তাঁর মতে, এটা রাজ্যের মাথায় নতুন পালক। এর জন্য তিনি গর্বিত। কিন্তু প্রাথমিক উচ্ছ্বাসের পরে যাদবপুরেরই অন্দরে প্রশ্ন আর সংশয় জাগছে, এটা কাঁটার মুকুট হয়ে উঠবে না তো?
এই প্রশ্ন আর সংশয়ের মূলে আছে পূর্ণ স্বশাসনের দায়িত্ব বহনের আর্থিক ঝক্কি। কেন্দ্রের দেওয়া এই স্বশাসনের ফলে নতুন পাঠ্যক্রম তৈরি, নতুন বিভাগ চালু, বিদেশি বিশ্ববিদ্যালয়ের সঙ্গে যৌথ উদ্যোগ, বিদেশি শিক্ষকদের আনা, তাঁদের জন্য বিশেষ বেতনহার, ক্যাম্পাসের বাইরে পাঠকেন্দ্র, গবেষণার জন্য বিশেষ কেন্দ্র— বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরি কমিশন বা ইউজিসি-র অনুমতি ছাড়াই সব করতে পারবে যাদবপুর। এতে আহ্লাদিত হওয়ারই কথা। তবু যে কাঁটা খচখচিয়ে বিঁধছে, তার কারণ এই সবই করতে হবে নিজেদের উদ্যোগে টাকা সংগ্রহ করে। ভারপ্রাপ্ত উপাচার্য প্রদীপকুমার ঘোষ মঙ্গলবার জানিয়েছিলেন, যে-সব পাঠ্যক্রম চালু করা যাবে, তার ব্যয়ভার বহন করতে হবে পড়ুয়াদের। এটা চিন্তার বিষয়।
এখন যাদবপুরের অধিকাংশ কোর্সই নামমাত্র ফি দিয়ে পড়া যায়। কিন্তু পূর্ণ স্বশাসনের পরে কর্তৃপক্ষ যে-সব নতুন পাঠ্যক্রম চালু করবেন, সেগুলিতে প্রচুর টাকা দিতে হবে ছাত্রছাত্রীদের। প্রদীপবাবু বুধবার বলেন, ‘‘বিদেশে যদি ক্যাম্পাস তৈরি করা যায়, সহজ হবে অর্থ সংগ্রহের পথ। পুরো বিষয়টিই খতিয়ে দেখতে হবে। দেখা যাক, যাদবপুর বিষয়গুলি কতটা বাস্তবায়িত করতে পারে।’’ তবে তিনি জানিয়ে দেন, পড়ুয়াদের উপরে চাপ পড়ে, এমন কিছু করার অভিপ্রায় তাঁদের নেই। ছাত্রছাত্রীদের উপরে আর্থিক দায় না-চাপিয়ে কতটা কী করা যায়, সেটাই দেখা হচ্ছে।
চালু কোনও পাঠ্যক্রমে আসন বাড়ালে তার খরচ কি ইউজিসি দেবে না? এর উত্তর মিলছে না। তবে যাদবপুর-কর্তৃপক্ষ সূত্রে জানা গিয়েছে, সে-ক্ষেত্রে আসন বাড়ানোর রাস্তায় এগোনোই হবে না।
পূর্ণ স্বশাসন দেওয়া হয়েছে ন্যাশনাল অ্যাসেসমেন্ট অ্যান্ড অ্যাক্রেডিটেশন কাউন্সিল (নাক)-এর বিচারে উঁচু স্থান পাওয়া শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলিকে। এই স্বশাসন অর্থহীন বলে মনে করেন যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষক সমিতি (জুটা)-র সাধারণ সম্পাদিকা নীলাঞ্জনা গুপ্ত। তিনি জানান, এই স্বশাসনের অর্থ শিক্ষার বেসরকারিকরণের দিকে এগিয়ে যাওয়া। গত বছর কেন্দ্র যখন বিষয়টি প্রথম জানিয়েছিল, তখনই জুটার তরফে আপত্তি জানানো হয়।
কিন্তু এই পূর্ণ স্বশাসনকে তাঁরা অর্থহীন বলছেন কেন?
নীলাঞ্জনাদেবীর বক্তব্য, বর্তমানের পাঠ্যক্রম বিষয়ক পুরো ব্যাপারটাই আগের মতো ইউজিসি-র নিয়ন্ত্রণে থাকবে। আর এর পরে যে-সব কোর্স চালু করা হবে, তার খরচ জোগাড় করতে হবে বিশ্ববিদ্যালয়-কর্তৃপক্ষকে। যার দায়ভার বর্তাবে পড়ুয়াদের উপরে। ‘‘পঠনপাঠনের পুরোপুরি স্বশাসন এতে মোটেই পাওয়া যাচ্ছে না। এতে প্রশাসনিক স্বশাসনেরও কোনও ইঙ্গিত নেই,’’ বলেন ওই শিক্ষক-নেত্রী। এসইউসি-র শিক্ষক-নেতা এবং যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক তরুণ নস্করের মতে, পূর্ণ স্বশাসন দেওয়ার নামে স্বাধিকারের অপব্যাখ্যা করা হয়েছে।
মুখ্যমন্ত্রী এই স্বশাসন প্রাপ্তিকে রাজ্যের মাথায় নতুন পালক মনে করলেও তাঁর দলেরই কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষক সংগঠন ওয়েবকুপা-র যাদবপুর শাখার নেতা মনোজিৎ মণ্ডল এতে খুব উচ্ছ্বসিত নন। ‘‘এ তো এক রকম সোনার পাথরবাটি! এই স্বশাসনে আমাদের পড়ুয়াদের উপরেই চাপ বাড়বে। যদি বিদেশে যাদবপুরের ক্যাম্পাস খোলা যায়, যাদবপুরের কিছুটা সুরাহা হতে পারে,’’ বলছেন মনোজিৎবাবু।