তৃষ্ণার শান্তি চুরি করে জল-সিন্ডিকেট

‘কোম্পানি’, ‘ডি কোম্পানি’, ‘সি কোম্পানি’ কী ভাবে খুন, অপহরণ, তোলাবাজি করে অপরাধজগৎ চালায়, দেখা যায় বলিউডি ছবিতে। এমনই হরেক ‘কোম্পানি’ গজিয়ে উঠেছে এই বাংলায়। যারা সরকারি জল হাতিয়ে দেদার মুনাফা কামাচ্ছে।

Advertisement

প্রভাত ঘোষ

শেষ আপডেট: ১৫ এপ্রিল ২০১৬ ০৩:৩৪
Share:

‘কোম্পানি’, ‘ডি কোম্পানি’, ‘সি কোম্পানি’ কী ভাবে খুন, অপহরণ, তোলাবাজি করে অপরাধজগৎ চালায়, দেখা যায় বলিউডি ছবিতে।

Advertisement

এমনই হরেক ‘কোম্পানি’ গজিয়ে উঠেছে এই বাংলায়। যারা সরকারি জল হাতিয়ে দেদার মুনাফা কামাচ্ছে। মুম্বইয়ের বিভিন্ন কোম্পানির মধ্যে যেমন সাপে-নেউলে সম্পর্ক, বাংলায় তা নয়। বরং উল্টোটাই। হাল আমলের পরিভাষায় যাকে বলে ‘সিন্ডিকেট’, তেমনই জোট বেঁধে জল চুরি চালাচ্ছে হাজারো কোম্পানি।

কেন্দ্রের পানীয় জল ও নিকাশি মন্ত্রকের হিসেব, দেশে পানীয় জল সরবরাহ করার জন্য কেন্দ্র ও রাজ্য মিলিয়ে বছরে খরচ হয় প্রায় ২০ হাজার কোটি টাকা। কিন্তু এই বিপুল খরচের সম্পূর্ণ সুরাহা সাধারণ মানুষ পান না জল চুরির জন্যই। ১ এপ্রিল ওই মন্ত্রকের আন্ডার সেক্রেটারি এ কে শ্রীবাস্তব রাজ্যের জনস্বাস্থ্য কারিগরি সচিব সৌরভ দাশকে চিঠি লিখে জল চুরির অভিযোগ জানিয়েছেন। তাঁর বক্তব্য, ‘জল সরবরাহে রাজ্য নিম্ন মানের প্লাস্টিক পাইপ ব্যবহার করায় তা মাঝপথে যেমন ভেঙে যায়, তেমনই চোরেরাও সহজে তা ফুটো করতে পারে। এই ভাবে ৫০ শতাংশ জলই মাঝপথে চুরি হয়ে যাচ্ছে।’

Advertisement

সরকারি হিসেব অনুযায়ী রাজ্যের ১৯টি জেলার ৩৪১ ব্লকে আট কোটি ৬৮ লক্ষ বাসিন্দার জন্য নলবাহী জলের ১৯০০ প্রকল্প আছে। রোজ মাথাপিছু বরাদ্দ ৪০ লিটার জল। সেই হিসেবে প্রতিদিন বাংলার জনগণকে বিনা পয়সায় প্রায় ৯২ কোটি গ্যালন জল সরবরাহ করার কথা রাজ্যের জনস্বাস্থ্য কারিগরি দফতরের।

সরকারি খাতা-কলম বলছে, রোজ ১৯টি জেলায় ৯২ কোটি গ্যালন পানীয় জলই সরবরাহ করা হচ্ছে। কিন্তু বাস্তবে পাওয়া যাচ্ছে ৩৮ কোটি গ্যালন। অর্থাত্ অর্ধেকেরও কম। রোজ ৫৪ কোটি গ্যালন বা ৫৮.৬৯ শতাংশ জল মাঝপথে স্রেফ চুরি হয়ে যাচ্ছে। গৃহস্থ সেই চোরাই জল শেষ পর্যন্ত পাচ্ছেন ঠিকই, তবে তাঁকে তা কিনতে হচ্ছে জলচোরেদের কাছ থেকে। যে-জল বিনামূল্যে পাওয়ার কথা, তা কিনতে হচ্ছে গাঁটের কড়ি খরচ করে।

কী ভাবে কারা চুরি করছে সরকারি জল? বেচছেই বা কী ভাবে?

দক্ষিণ ২৪ পরগনার গেঁওখালিতে চলছে বিশাল জল প্রকল্প। সেখান থেকে আটটি ব্লকের সম্পূর্ণ এবং দু’টি ব্লকের অর্ধাংশে পাইপের মাধ্যমে পানীয় জল সরবরাহ করার কথা সরকারি দফতরের। কিন্তু মাঝখানে আছে সোনারপুর-বৈকুণ্ঠপুরের অতনু, বিশু, পূর্ণেরা। তারা বাড়ি বাড়ি জল ‘পৌঁছে’ দেয়। এবং সেই জল আসে বেসরকারি কোম্পানির ছাপ মারা ব্যারেলে, সিল করা জ্যারিকেনে। ২০ লিটার ব্যারেলের দাম ৪০ টাকা। এ-রকমই একটি কোম্পানি আছে সোনারপুরের আড়াপাঁচ এলাকায়। সেটির মালিক অসীম মিস্ত্রি জানান, তাঁর কোম্পানির বয়স দু’মাস। স্বীকার করলেন, গরম পড়লে এই ধরনের ‘কোম্পানি’র সংখ্যা বাড়ে।

এমনই দু’তিনটি কোম্পানির সন্ধান মিলল বারুইপুরে। তাদের জলের ব্যারেল ও বোতলের গায়ে অত্যন্ত খরচসাপেক্ষ ‘রিভার্স অসমোসিস টেকনোলজি’ (জল শোধনের আধুনিক প্রযুক্তি) ব্যবহারের কথা স্পষ্ট করে লেখা। তবে কোনও জল কারখানাতেই পরিশোধনের আধুনিক যন্ত্রপাতি নেই। ওই সব এলাকায় আর্সেনিকে দূষিত মাটির তলা থেকে গভীর নলকূপের জল উঠছে। সেই সঙ্গে গেঁওখালি থেকে আসা সরকারি জলের পাইপলাইনে ফুটো করে জল আনা হচ্ছে। দু’ধরনের জল কারখানায় মিশিয়ে বোতলে ভর্তি করে পাঠিয়ে দেওয়া হচ্ছে বাড়ি বাড়ি। সহজ ব্যাপার। স্পষ্ট এলাকা ভাগ করা আছে ওই সব কোম্পানির মধ্যে। কোনও ঝগড়াঝাঁটি নেই।

শুখা জেলা বাঁকুড়ার এক থেকে চার নম্বর ব্লকের জন্য পাইপের জলের চার-চারটি প্রকল্প করে দিয়েছে জনস্বাস্থ্য কারিগরি দফতর। কিন্তু যত নতুন বাড়ি উঠেছে, ইঁদারা তৈরি করতে হয়েছে তার প্রতিটিতেই। কারণ? পুরসভার জল মেলে না। কিন্তু ভূগর্ভের জলও পান করা যায় না। বাসিন্দাদের ‘সেবা’য় এগিয়ে এসেছে শিবু-মুকুন্দেরা। সোনাবাঁধ, ইঁদপুরের জল প্রকল্প থেকে আসা সরকারি পাইপ ফুটো করে বাসিন্দাদের বাড়িতে বিশুদ্ধ জল পৌঁছে দিচ্ছে তারা। নগদে দাম মেটানোর বন্দোবস্ত তো রয়েছেই, আছে মাসিক ব্যবস্থাও।

সরকার কি জল চুরির কথা জানে না? চুরি ধরতে কী করছে তারা?

জল চুরির কথা জনস্বাস্থ্য কারিগরি দফতর ভাল করেই জানে। কিন্তু ওই দফতরের কর্তাদের বক্তব্য, চুরি রোখার পরিকাঠামো নেই তাঁদের। সেখানকার পদস্থ অফিসারদের কেউ কেউ অসহায়ের মতো বলছেন, ‘‘তবু তো জেলাগুলোর শহরাঞ্চলে জল চুরির খবর পেলে আমাদের লোকেরা গিয়ে হইচই করতে পারেন। কিন্তু চোরেরা অনেক শক্তিশালী। তারা জল চুরি চালিয়ে যেতে সিন্ডিকেট গড়েছে। কিন্তু আমাদের না আছে লোকবল, না আইনের সাহায্য।’’

দক্ষিণ ২৪ পরগনায় প্রতিদিন চার কোটি ২২ লক্ষ গ্যালনেরও বেশি জল সরবরাহ করে জনস্বাস্থ্য দফতর। তাদের দক্ষিণ সার্কেলের কার্যনির্বাহী ইঞ্জিনিয়ার গৌতম মুখোপাধ্যায় জানান, বজবজের ডোঙারিয়া জল প্রকল্প থেকে তাঁরা আটটি ব্লকের অন্তত ৩৫ লক্ষ মানুষকে জল দেন। ‘‘এই সুদীর্ঘ পাইপলাইনে নিশ্ছিদ্র নজরদারি চালিয়ে যাওয়া কি সম্ভব? তা ছাড়া জল চুরি ঠেকাতে আমাদের হাতে তো কোনও ফৌজদারি আইনই নেই। অগত্যা আমরা পুলিশকেই জানাই। কিন্তু পুলিশও কিছু করতে পারে না,’’ বললেন গৌতমবাবু।

প্রতিটি ব্লক ও সার্কেল অফিসে জল চুরির অভিযোগ জানিয়ে দায়ের করা এফআইআরের ‘রিসিট কপি’ জমা হয় দফতরে রাখা একটি ফাইলে। ব্যস! ওই পর্যন্তই।

ব্যবস্থা নেওয়া হয় না কেন?

উত্তরে মৌনী থাকার রাস্তাই নিচ্ছেন কর্তারা। তবে দফতরেই জল্পনা আছে: কে নেবে ব্যবস্থা? চোরেদের সঙ্গে অনেক কর্মী-কর্তারই তো ব্যবস্থা আছে! আর পুলিশের সঙ্গে আছে হপ্তা বা মাসিক ব্যবস্থা।

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
আরও পড়ুন
Advertisement