চাপা পড়ে আছে আরভদের গাড়ি।—নিজস্ব চিত্র
ছোট্ট হাতটা তখনও জানলার বাইরে বেরিয়ে রয়েছে। ভিতর থেকে ভেসে আসছে আর্তনাদ! ‘আঙ্কল বাঁচাও! আঙ্কল বাঁচাও!’
তাদের ছোট গাড়ির উপর তখন চেপে বসছে গরম বিটুমিন বোঝাই ট্যাঙ্কার। আস্তে আস্তে তার তলায় চেপ্টে যাচ্ছে আরভ-দের সদ্য কেনা গাড়ি। আরভের আর্তনাদের সঙ্গে সঙ্গে গরম বিটুমিনও ঝরে পড়ছিল ওই গাড়ির উপরে। একটা সময়ে ট্যাঙ্কার-বিটুমিনে ঢাকা পড়ে যায় গাড়ি সমেত আরভদের গোটা পরিবার।
অথচ কেউ এগিয়ে যায়নি। আসলে যেতে পারেনি। সকলেই রাস্তার ধারে দাঁড়িয়ে আরভদের গোটা পরিবারকে শেষ হতে দেখছিল। কিন্তু, ছ’বছরের আরভ বেঁচে ছিল প্রায় তিন ঘণ্টা। তাদের গাড়ি দুর্ঘটনার কবলে পড়ে সকাল সাড়ে ৮টা নাগাদ। আর তপ্ত ট্যাঙ্কারকে ঠান্ডা করতে দমকল যখন জল ছোড়ে তখন প্রায় সওয়া ১১টা। জল দেওয়ার ফলে ট্যাঙ্কার থেকে ধোঁয়া বেরনো শুরু হয়। সেই ধোঁয়াতেই দম আটকে থেমে যায় ছোট্ট আরভের প্রায় তিন ঘণ্টার আর্তনাদ!
আরও খবর
ফের দুর্গাপুর এক্সপ্রেসওয়ে! গরম পিচের ট্যাঙ্কার উল্টে মৃত ২ শিশু-সহ ৭
আরভের সঙ্গেই শেষ হয়ে যায় তাদের গোটা পরিবার। নতুন গাড়ি কিনে বিহারের ভোজপুরে যাচ্ছিলেন রেল সুরক্ষা বাহিনীর ইনস্পেক্টর রাজন কুমার। স্ত্রী, মা-বাবা এবং তিন সন্তানকে নিয়ে দুর্গাপুর এক্সপ্রেসওয়ে দিয়ে নিজেই গাড়ি চালিয়ে যাচ্ছিলেন। কিন্তু, গরম বিটুমিন বোঝাই একটি ট্যাঙ্কার আচমকাই তাঁদের গাড়ির উপর উল্টে পড়ে। ঘটনাস্থলেই মারা যান সকলে। তবে রাজন এবং তাঁর ছোট ছেলে আরভ বেশ কিছু ক্ষণ বেঁচেছিলেন বলে প্রত্যক্ষদর্শীরা জানিয়েছেন।
দুর্ঘটনার পর রাজন কুমারদের সেই গাড়ি। ছবি: সৌমেন দত্ত।
যে এক্সপ্রেসওয়ে দিয়ে গাড়ি ছুটিয়ে যাচ্ছিলেন রাজন, সেই জাতীয় সড়ক ইদানীং মৃত্যুফাঁদে পরিণত হয়েছে। গত চার মাসে ওই এক্সপ্রেসওয়েতে প্রায় ২০০টি দুর্ঘটনা ঘটেছে। বুধবারের হিসেব ধরলে মৃতের সংখ্যা ১০০ ছাড়িয়ে যাবে। এত অল্প সময়ে দেশের অন্য কোনও এক্সপ্রেসওয়েতে দুর্ঘটনায় এত জনের মৃত্যু হয়েছে কি না মনে করতে পারছেন না কেউই। জাতীয় সড়ক কর্তৃপক্ষের হিসেব, গড়ে প্রতি দিন একটি করে দুর্ঘটনা ঘটে এই এক্সপ্রেসওয়েতে। পুলিশের রিপোর্ট অনুযায়ী, বর্ধমানের জামালপুর থেকে পানাগড়ের মধ্যে পুজোর পর থেকে এ পর্যন্ত ৮৯টি দুর্ঘটনায় ৪২ জনের মৃত্যু হয়েছে। আহতের সংখ্যা পঞ্চাশের উপরে। এক্সপ্রেসওয়ের হুগলির অংশেও পরিসংখ্যান প্রায় একই। কয়েক মাস আগেই সিঙ্গুরের কাছে দুর্ঘটনার কবলে পড়ে তৃণমূল সাংসদ অভিষেক বন্দ্যোপাধ্যায়ের গাড়ি। তার পরে জাতীয় সড়কের নিরাপত্তা নিয়ে টনক নড়ে পুলিশের। এ মাসের প্রথমে হুগলির গুড়াপে পথ দুর্ঘটনায় সঙ্গীতশিল্পী কালিকাপ্রসাদ ভট্টাচার্যের মৃত্যুর পরে ফের সেই সব প্রশ্ন ওঠে। কিন্তু, কোনও কিছুতেই যে কাজ হচ্ছে না, তা এ দিনের ঘটনায় পরিষ্কার।
আরও খবর
জীবনের রক্ষণ সামলে ফিরলেন রিও ফার্দিনান্দ, কেমন ছিল সেই সময়?
এত দুর্ঘটনার কারণ কি কেবল গতি?
পুলিশ এবং জাতীয় সড়ক কর্তৃপক্ষ গতিকে অন্যতম কারণ হিসাবে দেখলেও তাদের মতে অন্য অনেক কারণ রয়েছে। কখনও উল্টো লেনে ঢুকে পড়ছে গাড়ি। কোথাও আবার রাস্তার পাশে পণ্যবাহী গাড়ি সার দিয়ে দাঁড়িয়ে। রাখা থাকে নির্মাণসামগ্রীও।
কিন্তু, পুলিশি নজরদারি সত্ত্বেও কেন রাস্তায় পণ্যবাহী গাড়ি দাঁড়িয়ে থাকা কিংবা লেন ভাঙার ঘটনা ঘটেই চলেছে? কোনও জবাব মেলেনি। এর সঙ্গে রয়েছে নির্ধারিত গতিসীমার উপরে গিয়ে গাড়ি চালানো। এমনিতে এই ধরনের রাস্তায় ঘণ্টায় ১০০ কিলোমিটারের উপরে গাড়ি চালানো যায় না। কিন্তু কার্যক্ষেত্রে দেখা যাচ্ছে, তার থেকেও জোরে গাড়ি চালানো হচ্ছে। নিয়মিত নজরদারি ও চালকদের বিরুদ্ধে আইনানুগ ব্যবস্থা নেওয়া হয় বলে পুলিশের দাবি। কিন্তু তার পরেও দুর্গাপুর এক্সপ্রেসওয়েতে দুর্ঘটনার প্রবণতা কমেনি।
গত কয়েক বছরে দুর্ঘটনার পরিসংখ্যান দেখে অনেকগুলি জায়গাকে ‘অতি দুর্ঘটনাপ্রবণ’ বা ‘ব্ল্যাক স্পট’ বলে ঘোষণা করা হয়েছে। কোনও জায়গা ‘ক্যাটাগরি এ ব্ল্যাক স্পট’, কোনও জায়গা ‘অতি দুর্ঘটনাপ্রবণ’ বলে রাজ্যের ট্র্যাফিক কর্তারা চিহ্নিত করেছেন। ওই সব জায়গায় উচ্চক্ষমতার চারটি করে ক্লোজড সার্কিট ক্যামেরা, ওয়াচ টাওয়ার, সিগন্যাল ব্যবস্থা করার প্রস্তাব দেওয়া হয়েছে। এ ছাড়াও উচ্চ ক্ষমতাসম্পন্ন ‘রোড লেন্স’ বসানো হবে। তার সাহায্যে গতিসীমা ভাঙলেই পুলিশ কন্ট্রোল রুমে খবর পৌঁছে যাবে। পাশাপাশি বসানোর কথা ছিল ‘স্পিড গভর্নর’। কিন্তু সবই প্রস্তাবের আকারেই রয়ে গিয়েছে।
দুর্ঘটনার পর অভিষেকের গাড়ি।—নিজস্ব চিত্র
অভিষেক বন্দ্যোপাধ্যায়ের গাড়ি দুর্ঘটনার কবলে পড়ার পর রাজ্য পুলিশের ডিজির নেতৃত্বে উচ্চপর্যায়ের একটি কমিটি গঠন করা হয়। কী ভাবে দুর্ঘটনা বন্ধ করা যায়, তা নিয়ে বিভিন্ন মহল থেকে নানা প্রস্তাব আসে। কিন্তু, এ দিন রাজ্য পুলিশের এক কর্তা জানিয়েছেন, কোনও প্রস্তাবই এখনও পর্যন্ত কার্যকর করা যায়নি। কেন?
রাজ্যের পরিবহণমন্ত্রী শুভেন্দু অধিকারী বলেন, ‘‘জাতীয় সড়কে যে এমন পর পর দুর্ঘটনা ঘটছে তা আমাদের নজরে রয়েছে। আমাদের মতে দুর্ঘটনা কমানোর একমাত্র পথ স্পিড গভর্নর বসানো। রাজ্য সরকার ঠিক করেছিল দুর্ঘটনা এড়াতে বিভিন্ন সড়কে গত ১ ফেব্রুয়ারি থেকে স্পিড গভর্নর বসাবে। কিন্তু, সুপ্রিম কোর্টের নির্দেশে তা আপাতত বন্ধ রাখতে হয়েছে।’’
আরও খবর
দরজায় বারবার ধাক্কা, খুলতেই জানালেন, ‘মাকে গলা টিপে মেরেছি’
পরিকল্পনা এবং প্রস্তাব যদি এ ভাবে আটকে থাকে, তাতে আখেরে ক্ষতি কার? টোল ট্যাক্স দিয়ে, গাঁটের কড়ি খরচা করে কে আর প্রাণ হাতে ওই পথে যেতে চাইবে? জাতীয় সড়ক কর্তৃপক্ষের এক কর্তার কথায়: ‘‘আমরা তো গাড়ি চালানোর নিয়ম-নীতি একপ্রস্ত ঠিক করে দিয়েছি। কিন্তু তা দেখভালের দায়িত্ব পুলিশের। কেউ যদি নির্ধারিত গতিসীমার উপরে গাড়ি চালায় তা পুলিশকেই দেখতে হবে।’’
কালিকাপ্রসাদের দুর্ঘটনাগ্রস্ত গাড়ি।—নিজস্ব চিত্র
পুলিশের এক কর্তার আবার পাল্টা প্রশ্ন, কী ভাবে দেখভাল হবে? অত লোকবল কি জেলা পুলিশের আছে? তাঁর মতে, ‘‘গাড়ি নিয়ে রাস্তায় যাঁরা বেরোচ্ছেন তাঁদেরকে আরও সতর্ক থাকতে হবে।’’ ডানকুনি থেকে দুর্গাপুর যাওয়ার পথে এক ছোট গাড়ির চালক বললেন, ‘‘কে আর প্রাণ হাতে করে যেতে চায় বলুন তো? আমি যদি অত গতিতে গাড়ি না চালাতে চাই, আবার এই রাস্তাতেই যাওয়ার প্রয়োজন হয় তবে তার জন্য অন্য কোনও লেনের কথা ভাবা হচ্ছে না কেন?’’ জাতীয় সড়ক কর্তৃপক্ষের কাছে এরও জবাব নেই।
যেমন জবাব নেই এই ভয়াল সড়কে গাড়ির জানলা থেকে আরও কত ছোট্ট হাত বেরিয়ে এসে জীবন প্রার্থনা করবে!