Dilip Ghosh

দিলীপ আবার চেনা নির্ঘোষে! অভিমানের দূরত্ব ঘুচিয়ে ভোটের ১২ মাস আগে থেকে ময়দানে নামা ত্রিফলা রণকৌশলের অঙ্গ

রাজ্য বিজেপিতে যে তিন জনকে সর্বোচ্চ নেতা হিসেবে দেখা হচ্ছে, তাঁদের দু’জন সাংবিধানিক পদাধিকারী। সুকান্ত কেন্দ্রীয় প্রতিমন্ত্রী। শুভেন্দু রাজ্যের বিরোধী দলনেতা। একমাত্র দিলীপ কোনও পদে নেই।

Advertisement

ঈশানদেব চট্টোপাধ্যায়

শেষ আপডেট: ২৪ মার্চ ২০২৫ ০৯:০১
Share:
Sukanta, Dilip And Suvendu Picture

(বাঁ দিক থেকে) সুকান্ত মজুমদার, দিলীপ ঘোষ এবং শুভেন্দু অধিকারী। —ফাইল চিত্র।

কখনও তিনি সরস, কখনও তিনি সরোষ! দিলীপ ঘোষকে এ ভাবেই অনেক বছর ধরে দেখতে অভ্যস্ত ছিল বঙ্গবাসী। কিন্তু লোকসভা ভোটের পর ক্রমশ তিনি গুটিয়ে নিয়েছিলেন নিজেকে। অতি সম্প্রতি আবার দেখা দিতে শুরু করেছে পুরনো সেই দিলীপ-কথা। কেন? কী এমন ঘটল যে, অভিমানী নীরবতার খোলস ছেড়ে বেরিয়ে এলেন বাংলায় বিজেপির ‘সবচেয়ে সফল’ রাজ্য সভাপতি?

Advertisement

গত লোকসভা নির্বাচনে তাঁকে তাঁর জেতা আসন মেদিনীপুরে লড়তে দেয়নি দল। বর্ধমান-দুর্গাপুরে লড়ে হেরে যান। তার পর থেকেই রাজনীতির দৈনন্দিন সম্মুখসমর থেকে দিলীপ কিছুটা আড়ালে সরে গিয়েছিলেন। দলকে নিয়ে তাঁর ক্ষোভ আর অভিমানের কথাও প্রকাশ হয়ে পড়েছে একাধিক বার। কিন্তু গত মঙ্গলবারের পর থেকে সে ছবি হঠাৎ বদলাতে শুরু করেছে। ওই দিন দিলীপ বিধানসভায় শুভেন্দু অধিকারীর ঘরে বসে বৈঠক করেন বিজেপি বিধায়কদের সঙ্গে।

শুভেন্দু-দিলীপের এই মৈত্রীবার্তার আগের দিন দিল্লিতে ছিলেন শুভেন্দু। কেন্দ্রীয় মন্ত্রী তথা বিজেপির রাজ্য সভাপতি সুকান্ত মজুমদারের বাসভবনে সন্ধ্যায় বিজেপি সাংসদদের সঙ্গে বৈঠকে উপস্থিত ছিলেন তিনি। তার পর যান অমিত শাহের সঙ্গে বৈঠক করতে। গভীর রাতে কলকাতায় ফিরে আসেন। এবং পরদিনই তাঁর আমন্ত্রণে বিধানসভায় যান দিলীপ।

Advertisement

এর তিন দিনের মধ্যেই পুরনো মেজাজের দিলীপকে দেখা গেল খড়্গপুরে। পর পর দু’দিন তিনি গলা ফাটিয়ে চ্যালেঞ্জ ছুড়লেন রাজ্যের শাসকদলের কর্মীদের। দিল্লি, কলকাতার বৈঠকের সঙ্গে খড়্গপুরের এই নির্ঘোষের মধ্যে সমীকরণ কী? বাংলার ভোটের জন্য বিজেপির কেন্দ্রীয় নেতৃত্বের রণকৌশলেরই ইঙ্গিত এটি।

পরের বছরই বাংলায় বিধানসভা ভোট। আর এ রাজ্যের জনমানসে বিজেপির মুখ বলতে এখন তিন জনই। সুকান্ত, শুভেন্দু, দিলীপ। ‘কোণঠাসা’ দিলীপকে নতুন করে ‘গুরুত্ব’ দিয়ে ভোটের আগে তাঁকে ময়দানে ফেরানো হচ্ছে বলে অনেকেই মনে করছেন। বিধানসভার বৈঠক থেকে খড়্গপুরের মেজাজে তারই প্রতিফলন। শুধু দিলীপের ‘পুনর্বাসন’ নয়, বিজেপির কেন্দ্রীয় নেতৃত্ব আর একটি বিষয়ও যে চাইছেন তা স্পষ্ট। তা হল ‘তিন দিকে চলা’ তিন নেতার মধ্যে সমন্বয়সাধন। সুকান্ত-শুভেন্দুর মধ্যে দীর্ঘ ফোনালাপ আর বৈঠকের মধ্যে দিয়ে সম্প্রতি সেই সমন্বয়বৃদ্ধির প্রতিফলনও দেখা যাচ্ছে। বর্তমানে দলের এই দুই ‘ফলা’র সঙ্গে দিলীপকে জুড়ে ভোটের আগে ত্রিফলা তৈরিই এখন কেন্দ্রীয় বিজেপির লক্ষ্য।

‘মুখর’ দিলীপের ক্ষেত্রে এই মুহূর্তে একটি সুবিধাও রয়েছে। বাকি দু’জন সাংবিধানিক পদাধিকারী। সুকান্ত কেন্দ্রীয় প্রতিমন্ত্রী। শুভেন্দু রাজ্য বিধানসভার বিরোধী দলনেতা। একমাত্র দিলীপ এখন সাংবিধানিক বা সাংগঠনিক কোনও পদে নেই। সুকান্ত বা শুভেন্দুর পক্ষে যে ধরনের কথাবার্তা বলা সম্ভব বা উচিত নয়, দিলীপের ক্ষেত্রে সে সবে এখন বাধা নেই। সে কথা মাথায় রেখেই ‘পুরনো মেজাজের’ দিলীপকে বিজেপি সুচিন্তিত ভাবে ফেরাতে চাইছে বলে অনেকের ধারণা।

দিলীপ বিজেপির রাজ্য সভাপতি থাকাকালীন প্রথমে বিধায়ক এবং পরে সাংসদ হয়েছিলেন। ২০১৬ থেকে ২০২৪ সাল পর্যন্ত টানা জনপ্রতিনিধি ছিলেন। ২০২৪ সালের জুন মাস থেকে তিনি আর জনপ্রতিনিধি নন। কিন্তু দলের কর্মী-সমর্থকদের একটা বড় অংশের মধ্যে তাঁর জনপ্রিয়তা সংশয়াতীত। অনেকে বলেন, সেই জনপ্রিয়তার অন্যতম কারণ বিভিন্ন সময়ে দিলীপের নানান গরমাগরম বয়ান। যে সব বয়ানকে কেউ কেউ ‘কুকথা’ বলেও আখ্যা দেন। কিন্তু প্রতিপক্ষ যা-ই বলুক, দিলীপের ‘চেনা মেজাজের’ সমর্থকের সংখ্যা বিজেপিতে কম নয়। বিজেপি সূত্রের দাবি, রাজ্য বিজেপির বর্তমান দুই শীর্ষনেতাও চাইছেন, যে ভূমিকাতেই হোক, দিলীপ আবার সামনের সারিতে সক্রিয় হোন।

দিলীপ নিজে অবশ্য এমন কোনও ‘কৌশলে’র কথা স্বীকার করছেন না। শুক্রবার খড়্গপুরে দু’টি নবনির্মিত কংক্রিট রাস্তার উদ্বোধনে গিয়েছিলেন তিনি। তাঁর সাংসদ তহবিলের অর্থেই ওই রাস্তা দু’টি তৈরি। কিন্তু সেখানে তৃণমূল দিলীপের গাড়ির সামনে বসে পড়ে তাঁর পথ আটকায়। তৃণমূলের কয়েক জন মহিলা কর্মীর সঙ্গে দিলীপের উত্তপ্ত বাদানুবাদের ছবিও সামনে আসে। বাধার মুখে পড়ে যে ভাবে সে দিন দিলীপ মেজাজ হারান, ওটাই তাঁর ‘স্বাভাবিক মেজাজ’ বলে দিলীপের দাবি। মেদিনীপুরের প্রাক্তন সাংসদের কথায়, ‘‘সাংসদ তহবিলের টাকায় রাস্তা হয়েছে। সেই রাস্তার উদ্বোধন করতে গিয়েছি। সরকারি কাজ বলতে পারেন। দলের কাজ নয়। সেখানে এসে গোলমাল করা শুরু করল। যে ভাবে জবাব দেওয়া দরকার, সে ভাবেই দিয়েছি।’’ দিলীপের কথায়, ‘‘আমি দলের কোনও পদে নেই। আমি কোনও রাজনৈতিক কর্মসূচিতে যাইও না। বিভিন্ন সামাজিক কর্মসূচিতে যাই। খড়্গপুরে দলের কোনও কর্মসূচি ছিল না। সুতরাং ওই ঘটনার মধ্যে দলের কৌশল খুঁজে লাভ নেই।’’

প্রশ্নও সেখানেই। দলের কোনও পদে না থাকার কারণেই কি এই রকম চড়া মেজাজে ফিরে যাওয়া দিলীপের পক্ষে এখন আগের চেয়েও সুবিধাজনক? দিলীপ বলছেন, ‘‘আপনি বরং উল্টো দিক থেকে দেখুন। এটা স্থানীয় তৃণমূল নেতাদের কৌশল। বিধানসভা নির্বাচনে খড়্গপুর সদরে তৃণমূলের টিকিট কে পাবে, তা নিয়ে দড়ি টানাটানি করতে গিয়ে আমাকে নিশানা করা।’’ দিলীপের কথা, ‘‘দিলীপ ঘোষের উপরে হামলা করলে, দিলীপ ঘোষের রাস্তা আটকালে, দিলীপ ঘোষের সঙ্গে বচসায় জড়ালে চট করে খবরে আসা যায়। সুতরাং খড়্গপুরে এখন তৃণমূলের দুই টিকিটপ্রার্থীর মধ্যে লড়াই শুরু হয়েছে। কে দিলীপ ঘোষের সঙ্গে কত বেশি গোলমালে জড়াতে পারে। প্রাক্তন বিধায়ক এ বার ফের টিকিট পাওয়ার জন্য অনুগামীদের পাঠিয়েছিলেন উদ্বোধনের দিন গোলমাল পাকাতে। সেটা দেখার পর প্রাক্তন বিধায়কের বিরোধী গোষ্ঠী আমার বাড়ির সামনে এসে বিক্ষোভ দেখাচ্ছে।’’

রাজ্য বিজেপির প্রধান মুখপাত্র তথা সাংসদ শমীক ভট্টাচার্যও ‘কৌশল’ বা ‘পরিকল্পিত মেজাজ’-তত্ত্ব মানতে নারাজ। শমীকের কথায়, ‘‘রাজনীতিকরা তো অতিমানব নন! সবাই তো রক্তমাংসের মানুষ! দিলীপদাকে যে ভাবে তৃণমূল সর্বত্র বিরক্ত করছে, যে ভাবে বার বার হাই কোর্টে গিয়ে বিরোধী দলনেতাকে কর্মসূচির অনুমতি আদায় করতে হচ্ছে, তাতে এই বিরক্তির বিস্ফোরণ স্বাভাবিক।’’

রাজ্য বিজেপির সভাপতি সুকান্তর বয়ান কিন্তু একটু অন্য রকম। এবং তাৎপর্যপূর্ণও। আনন্দবাজার ডট কমকে সুকান্ত বলছেন, ‘‘দিলীপদা দিলীপদা-ই। ওটাই দিলীপদার স্টাইল। প্রত্যেকের নিজস্ব চালচলচন রয়েছে। দিলীপদারও রয়েছে, শুভেন্দুদারও রয়েছে, আমারও রয়েছে। একটা ফুলের তোড়াকে নানা রকমের ফুল দিয়ে সাজালে, তবেই তোড়াটা সুন্দর দেখায়। সব ফুল এক রকমের হয়ে গেলে একঘেয়ে লাগতে পারে। দলেও সে ভাবেই নেতাদের চালচলনে নিজস্বতা থাকে। সবাই এক রকম হলে, সবাই একই ভাষায় কথা বললে ভাল লাগবে না।’’ অর্থাৎ, দিলীপকে যে ‘অবতারে’ ভাল লাগে, বিধানসভা নির্বাচনের এক বছর আগে সে ‘অবতারে’ই ফেরানোর ‘কৌশল’? সুকান্ত সরাসরি অস্বীকার করছেন। বলছেন, ‘‘কৌশল-টৌশল নয়।’’ কিন্তু তার পরেই ফের ইঙ্গিতপূর্ণ মন্তব্য করছেন। রাজ্য বিজেপির সভাপতি বলছেন, ‘‘ক্রিকেটে দ্রুত রান তোলার জন্য যেমন আপার অর্ডারে ঝোড়ো ব্যাটারকে পাঠানো হয়, তেমনই এক জন অ্যাঙ্কর ব্যাটারকেও লাগে, যিনি টিকে থাকবেন, ইনিংসটাকে শেষ পর্যন্ত ধরে রাখবেন। সেই ব্যাটার হিসেবে আমি আছি তো। অন্যেরা যে যেমন স্টাইলে ব্যাট করছেন, সেটাও জরুরি।’’

‘দলীয় কৌশল’ তত্ত্ব উড়িয়ে দিয়েও ‘ক্রিকেটীয় কৌশল’কে উদাহরণ হিসেবে টানলেন সুকান্ত। যতই হোক, আইপিএলের মরসুম চলছে। শনিবার আইপিএলের মাঠে দিলীপকে দেখাও গিয়েছে। কখনও জয় শাহের সঙ্গে, কখনও সৌরভ গঙ্গোপাধ্যায়ের সঙ্গে, কখনও গ্যালারিতে দাঁড়িয়ে দর্শকদের উদ্দেশে হাত নাড়াতে নাড়াতে। মাঠে নামারই প্রস্তুতি শুরু করলেন।

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
আরও পড়ুন
Advertisement