আর কত ভল্ট দেখাবেন সৌমিত্র? প্রশ্ন রাজ্য বিজেপিতে। প্রতীকী ছবি
এক বা দু’বার নয়। ডিগবাজিতে মোট ৩৫ বার নিজের রেকর্ড নিজে ভেঙেছিলেন তিনি। তাঁর সেই রেকর্ড ভাঙার লোক কি পশ্চিমবঙ্গ নামক ‘গোকূলে’ বাড়িছে? বিবৃতির ডিগবাজিতে যে দ্রতগতিতে গোমাতার পূজারি সৌমিত্র খাঁ এগোচ্ছেন, তাতে বিশ্ববিশ্রুত পোলভল্টারের নিজের রেকর্ড ভাঙার রেকর্ড অক্ষত থাকলে হয়!
কোথায় ইউক্রেন আর কোথায় রঙ্গ-ভরা বঙ্গদেশ। কোথায় বিশ্ব পোলভল্টের আসর আর কোথায় বিবৃতিসর্বস্ব রাজনীতি! নিছকই লঘু চাপল্য। তবু সৌমিত্রের ডিগবাজি দেখে একটাই নাম মনে পড়ে— সের্গেই বুবকা।
পোলভল্টার বুবকার জগৎজোড়া খ্যাতি নিজের রেকর্ড নিজে ভাঙার জন্য। ৩৫ বার রেকর্ড ভাঙার রেকর্ড গড়েছেন তিনি। অতবার না হলেও রাজনৈতিক ডিগবাজিতে মুন্সিয়ানার ছাপ রেখেছেন বিষ্ণুপুরের সাংসদ। গত বছর সাংবাদিক বৈঠক ডেকে তৃণমূলে চলে-যাওয়া স্ত্রীকে বিবাহের বন্ধন থেকে বিচ্ছিন্ন করেছিলেন। সে ছিল ২০২০ সালে সম্ভবত সবচেয়ে চমকপ্রদ ঘটনা। সাংবাদিক বৈঠকে বিবাহবিচ্ছেদ। কিন্তু সেই চমককেও পিছনে ফেলে দিচ্ছে ঘটা করে রাজনৈতিক সিদ্ধান্ত ঘোষণার পর সৌমিত্রের ডিগবাজি।
‘বাংলার বুবকা’ ডিগবাজির সর্বশেষ নমুনাটি দেখিয়েছেন বুধবার। শুরু দুপুরের কিছু পরে। ফেসবুকে পোস্ট করে তিনি বিজেপি যুব মোর্চার রাজ্য সভাপতি পদ থেকে ইস্তফা দেওয়ার ঘোষণা করেন। তার একটু পরে ফেসবুকে ‘লাইভ’ করে রাজ্য সভাপতি দিলীপ ঘোষ ও বিরোধী দলনেতা শুভেন্দু অধিকারীর কঠোর নিন্দা করেন। কিন্তু কয়েক ঘণ্টা কাটতে না কাটতেই ডিগবাজি। সংবাদমাধ্যমে জানিয়ে দেন, নাহ্, তিনি পদত্যাগ করছেন না। দাবি করেন, কেন্দ্রীয় নেতৃত্বের অনুরোধেই তাঁর সুরবদল। রাজ্য বিজেপি নেতারা অবশ্য বলছেন, ‘‘ওঁকে কেউ চাপ দেয়নি। সৌমিত্র নিজেই চাপ দিতে চেয়েছিলেন। কাজ হবে না বুঝতে পেরে সিদ্ধান্ত বদলে ফেলেন।’’ রাজ্য সভাপতি দিলীপের কথায়, ‘‘ফেসবুকে ইস্তফা দেওয়া যায় না। তুলেও নেওয়া যায় না। এ ভাবে সংগঠন চলে না।’’
বারবার দিলীপের সঙ্গে সঙ্ঘাতের পথে হেঁটেছেন সৌমিত্র। ফাইল চিত্র
একই কথা দিলীপ বলেছিলেন মাস আটেক আগেও। ২০২০ সালের ২৪ অক্টোবর এ ভাবেই যুব মোর্চার সভাপতি পদ ছেড়েছিলেন সৌমিত্র। সে বার ফেসবুকে নয়, দলীয় হোয়াটসঅ্যাপ গ্রুপে লিখেছিলেন সিদ্ধান্তের কথা। সে দিন ছিল দুর্গাপুজোর অষ্টমী। সেই সকালে সৌমিত্র দলের পদাধিকারীদের নিয়ে তৈরি হোয়াটসগ্রুপে লিখেছিলেন, ‘শুভ মহাষ্টমী। সকলে ভাল থাকবেন। আপনাদের খুবই সহযোগিতা পেয়েছি। আমি চাই বিজেপি-কে সরকারে আনতেই হবে। তাই হয়ত আমার অনেক ভুল ছিল যাতে দলের ক্ষতি হচ্ছিল। তাই আমি ইস্তফা দেব আর সকলে ভাল থাকবেন। যুব মোর্চা জিন্দাবাদ, বিজেপি জিন্দাবাদ, মোদীজি জিন্দাবাদ।’
দুপুরেই ডিগবাজি! ‘বাংলার বুবকা’ লিখেছিলেন, ‘কোনও কমিটি চেঞ্জ (বদল) হচ্ছে না আর আমার তোমাদেরকে ছেড়ে থাকা সম্ভব নয়।তাই ফিরে এলাম।টিএমসি-কে হারানোর জন্য সব কিছু ত্যাগ করতে রাজি আছি। জয় শ্রী রাম, জয় মা দুর্গা, বিজেপি জিন্দাবাদ, মোদীজি জিন্দাবাদ।’
সে বার সৌমিত্রের তৈরি যুব মোর্চার প্রায় সব জেলা কমিটিই ভেঙে দিয়েছিলেন দিলীপ। অভিযোগ ছিল, সৌমিত্র সমান্তরাল সংগঠন বানাতে চাইছেন। রাজ্য বিজেপি নেতারা তখন বলেছিলেন, হোয়াটসঅ্যাপ গ্রুপে পদত্যাগ করে সৌমিত্রর আশা ছিল দিলীপের উপরে চাপ তৈরি করা যাবে। কিন্তু কেন্দ্রীয় নেতৃত্ব দিলীপকেই সমর্থন করছেন বুঝতে পেরে ঘরের ছেলে ঘরে ফেরেন। তখন যা বলেছিলেন, বুধবারও দিলীপ তা-ই বলেছেন, ‘‘ও যে গিয়েছে বা ফিরেছে, তার কিছুই তো আমি জানি না! সবটাই হোয়াটসঅ্যাপে ঘটেছে।’’
হোয়াটসঅ্যাপ গ্রুপ ছাড়া এবং ঢোকা সংক্রান্ত ডিগবাজির রেকর্ডও আছে। জুন মাসেই সৌমিত্র বিজেপি-র একটি সাংগঠনিক হোয়াটসঅ্যাপ গ্রুপ ত্যাগ করেন। ৫ জুন দিলীপের ডাকা বিষ্ণুপুরের সাংগঠনিক বৈঠকেও যোগ দেননি এলাকার সাংসদ। কলকাতায় ছিলেন। বলেছিলেন, ‘‘লকডাউন চলছে। মিটিং-মিছিল বন্ধ আছে। রাজ্য সরকারের সেই লকডাউনের সিদ্ধান্তকে মান্যতা দিয়েই আমি বৈঠকে না থাকার সিদ্ধান্ত নিয়েছি।’’ বিজেপি-র অন্দরের বক্তব্য, সেই গ্রুপে আবার ঢুকে পড়বেন সৌমিত্র। যদি না ইতিমধ্যেই পড়ে থাকেন।
ন্যাড়া হয়ে বা হতে চেয়েও দলকে অস্বস্তিতে ফেলেছেন সৌমিত্র। ফাইল চিত্র
তৃণমূলের সৌমিত্র বিজেপি-তে যোগ দিয়ে সাংসদ হওয়ার পর যুবমোর্চার সভাপতি হয়েছিলেন মূলত কৈলাস বিজয়বর্গীয় এবং মুকুল রায়ের ‘পছন্দ’ হিসাবে। কিন্তু তাঁদেরও বিভিন্ন সময়ে ডিগবাজি-জনিত অস্বস্তিতে ফেলেছেন তিনি। প্রকাশ্যে বিভিন্ন মন্তব্য করে দলের মুখ পুড়িয়েছেন। কেন্দ্রীয় নেতৃত্বের ধমক খেয়েছেন। ‘চাকরির প্রতিশ্রুতি’ দেওয়ার কার্ড বিলি করেও প্রত্যাহার করেছেন। ডিগবাজি!মাথা ন্যাড়া করে যজ্ঞ করেছেন। দলের ধমক খেয়েছেন। ত্রিশূল বিলি করার কর্মসূচি ঘোষণা করে গোটা দলকে অস্বস্তিতে ফেলেছেন। সেই কর্মসূচিতে দলের সমর্থন পাননি। ধমক খেয়েছেন। কর্মসূচি বাতিল করেছেন। ডিগবাজি!
বারবার নেতৃত্বের ধমক সম্পর্কে সরল স্বীকারোক্তি করেছেন, ‘‘আমি ছোট। ছোটরা যেমন ভালবাসা পায়, তেমন কখনও কখনও বকুনিও খায়।’’
গত জুন মাসে আবার ন্যাড়া হওয়ার ঘোষণা করেছিলেন। কিন্তু করেননি। ডিগবাজি। আনন্দবাজার অনলাইনকে ফোনে বলেছিলেনন, ‘‘বলেছিলাম ঠিকই। কিন্তু শেষ পর্যন্ত ঠিক করেছি ন্যাড়া হব না।’’ রাজ্য বিজেপি সূত্রে খবর, দলই বলেছিল মস্তক মুণ্ডন না করতে।
বাংলার রাজনীতি কি দেখতেই থাকবে ‘বাংলার বুবকা’-র ডিগবাজিতে নিজস্ব রেকর্ডভঙ্গ? সরাসরি জানতে চেয়েছিল আনন্দবাজার অনলাইন। ‘বুবকা’ বলেছেন, ‘‘আমি আবেগপ্রবণ। আবেগ থেকেই রাজনীতিতে এসেছি। মানুষের জন্য কাজ করতে চাই। তাতে বাধা পেলে এই রকম করে ফেলি।’’
আর ডিগবাজির রেকর্ড ভাঙতে থাকে।