ভোটার কার্ডের এপিক নম্বর ঘিরে বিতর্ক। গ্রাফিক: আনন্দবাজার অনলাইন।
একাধিক ভোটারের একই এপিক নম্বর! মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের তোলা অভিযোগ নিয়ে ব্যাখ্যা দিতে গিয়ে বিতর্কে নতুন মাত্রা যোগ করে দিল দেশের নির্বাচন কমিশন। রবিবার কমিশনের তরফে বিজ্ঞপ্তি প্রকাশ করে জানানো হয়েছে, একাধিক ভোটদাতার ‘এপিক’ বা সচিত্র পরিচয়পত্রের নম্বর পরস্পরের সঙ্গে মিলে যাওয়ায় কোনও অস্বাভাবিকতা নেই। বিবৃতিতে লেখা হয়েছে, ‘‘সমাজমাধ্যমের পোস্টে ও সংবাদ প্রতিবেদনে উঠে আসা কিছু অভিযোগ নির্বাচন কমিশনের নজরে এসেছে। সেখানে দুই ভিন্ন রাজ্যের ভোটারের একই এপিক নম্বর থাকার বিষয়টি উল্লেখ করা হয়েছে। এ বিষয়ে কমিশন স্পষ্ট জানাচ্ছে যে, কিছু ভোটারের এপিক নম্বর একই হতে পারে। তবে তাঁদের অন্যান্য বিবরণ, যেমন জন্মসংক্রান্ত তথ্য, বিধানসভা কেন্দ্র, এবং ভোটকেন্দ্র সম্পূর্ণ ভিন্ন।’’
কমিশনের এই বিজ্ঞপ্তির পর অনেকেই ‘বিস্মিত’! বাংলার শাসকদল বলতে শুরু করেছে, ‘অবশেষে সত্যিটা স্বীকার করতে বাধ্য হল কমিশন। এবং সেটি হল মমতার চাপেই।’ একই এপিক নম্বরের একাধিক ভোটার থাকার ব্যবস্থা নিয়ে শুধু তৃণমূলই প্রশ্ন তুলল না, প্রশ্ন তুলল সিপিএমও। এমনকি বিজেপিও বলছে, এই ব্যবস্থা বদলালে তাদের আপত্তি নেই।
এপিক নম্বর বিতর্কে নির্বাচন কমিশনের বিবৃতি। ছবি: এক্স।
মমতা অভিযোগ করেছিলেন, পশ্চিমবঙ্গের ভোটারের সচিত্র পরিচয়পত্রের নম্বর মিলে যাচ্ছে গুজরাত বা হরিয়ানার ভোটারের সঙ্গে। কেন্দ্রীয় নির্বাচন কমিশনের বিরুদ্ধে আঙুল তুলে বিজেপিকে সুবিধা পাইয়ে দেওয়ার অভিযোগও তোলেন বাংলার মুখ্যমন্ত্রী। কমিশন সেই ‘ত্রুটি’ অস্বীকার না করায় তৃণমূল আরও উজ্জীবিত। বাড়ি বাড়ি গিয়ে স্ক্রুটিনির যে দাওয়াই তৃণমূল দিচ্ছে, তার সঙ্গে সহমত সিপিএমও। তবে মমতাই ‘আসল সত্য’ তুলে আনলেন বলে মানছে না বাংলার প্রাক্তন শাসকদল।
ভোটার তালিকা নিয়ে সংশয় প্রকাশ করে নানা কথা দেশের নানা প্রান্ত থেকেই শোনা যাচ্ছিল। বিশেষত হরিয়ানায় গত বিধানসভা নির্বাচনের পর থেকে। তৃণমূলের দাবি, সমস্যাটা প্রথম বার স্পষ্ট ভাবে চিহ্নিত করেছেন পশ্চিমবঙ্গের মুখ্যমন্ত্রীই। দলের রাজ্য সাধারণ সম্পাদক কুণাল ঘোষ বলছেন, ‘‘এই প্রথম কেউ সুনির্দিষ্ট ভাবে গরমিলটা চিহ্নিত করতে পেরেছেন। হরিয়ানা বা মহারাষ্ট্রে ভোটের আগে কংগ্রেস অনেক হাঁকডাক করল। গরমিলের অভিযোগ তুলল। কিন্তু গরমিল কোথায়, তা দেখিয়ে দিতে পারেনি। পশ্চিমবঙ্গের মুখ্যমন্ত্রী স্পষ্ট ভাবে প্রমাণ দিয়ে দেখিয়ে দিয়েছেন। তাই নির্বাচন কমিশনের আর অস্বীকার করার কোনও উপায় নেই।’’
কমিশনের ব্যাখ্যা অনুযায়ী, আগে গোটা দেশে কোনও অভিন্ন বা কেন্দ্রীভূত ব্যবস্থার মাধ্যমে ভোটার পরিচয়পত্রের নম্বর নির্ধারিত হত না। বিভিন্ন রাজ্যে বা কেন্দ্রশাসিত অঞ্চলে মুখ্য নির্বাচনী আধিকারিকদের দফতর থেকে কার্ডের নম্বর নির্ধারিত হত। তাই অনেক ক্ষেত্রে আলাদা আলাদা রাজ্যে একই নম্বরের কার্ড খুঁজে পাওয়া যাচ্ছে। কমিশন অবশ্য বিজ্ঞপ্তিতে এ-ও জানিয়ে দিল যে, ভবিষ্যতে একই নম্বরের দু’টি কার্ড যাতে না-থাকে, তা কমিশন নিশ্চিত করবে।
একই নম্বরের ভোটার পরিচয়পত্র বিভিন্ন রাজ্যে থাকার কারণ সম্পর্কে কমিশনের ব্যাখ্যায় তৃণমূল সন্তুষ্ট নয়। কুণালের কথায়, ‘‘বাংলার মুখ্যমন্ত্রীর তোলা প্রশ্নের কোনও উত্তর তো কমিশন দিতে পারেনি। কী ভাবে এই ঘটনা ঘটল, তার কোনও বিশ্বাসযোগ্য উত্তর নেই। বরং বিবৃতির শেষ দুই স্তবকে কমিশন পুরোপুরি মেনে নিয়েছে যে, এই অভিযোগ সত্য। এর নিরসনে পরবর্তী পদক্ষেপ কী হবে, তা-ও লিখে দিতে বাধ্য হয়েছে।’’ কুণাল আরও বললেন, ‘‘এদের উপরে আমাদের কোনও ভরসা নেই। সংশোধন করবে বলছে। কিন্তু কী ভাবে সংশোধন করবে? সেই ব্যবস্থা কি আদৌ ত্রুটিমুক্ত? এ সব একদমই স্পষ্ট নয়। তাই আমরা এদের ভরসায় থাকছি না। বাড়ি বাড়ি গিয়ে স্ক্রুটিনি করার যে সিদ্ধান্ত তৃণমূল নিয়েছে, তা আরও জোরকদমে চলবে।’’
তৃণমূলের ‘স্ক্রুটিনি’ দাওয়াইয়ের সঙ্গে সিপিএম সাংসদ তথা আইনজীবী বিকাশরঞ্জন ভট্টাচার্যও সহমত। বিকাশ বলছেন, ‘‘অনলাইনে সব কাজ করার চেষ্টা করলে এ সব গরমিল হবেই।’’ তা হলে কি ভোটার তালিকায় নাম তোলার অনলাইন ব্যবস্থা বন্ধ করতে চায় সিপিএম? বিকাশ বলছেন, ‘‘না, বন্ধ করতে চাই না। অনলাইনে নাম তোলা হচ্ছে হোক। কিন্তু তার পাশাপাশি স্ক্রুটিনিটাও দরকার। প্রযুক্তির ভরসায় সব কিছু হয় না। পাশাপাশি একটা বিকল্প ব্যবস্থাও রাখতে হয় ভুল-ত্রুটি চিহ্নিত করার জন্য। বাড়ি বাড়ি গিয়ে স্ক্রুটিনি খুব জরুরি।’’
নির্বাচন কমিশনের দেওয়া ব্যাখ্যাকেও বিকাশ মান্যতা দিতে রাজি নন। তিনি বলছেন, ‘‘কমিশন যে সব যুক্তি দিয়েছে, সেগুলো হচ্ছে অপরাধীদের সুযোগ করে দেওয়ার মতো যুক্তি। ভোটকেন্দ্রে ভোটকর্মীরা শুধু কার্ডের নম্বরই মিলিয়ে দেখেন। গোটা কার্ডটা কেউ পড়ে দেখেন না। কোন বিধানসভা, কী ঠিকানা, এ সব কেউ দেখেন না। সুতরাং কার্ডের নম্বর ইউনিক হতেই হবে। একই নম্বরে দুই বা ততোধিক কার্ড মোটেই নিশ্ছিদ্র ব্যবস্থার লক্ষণ নয়।’’
তবে বাংলার মুখ্যমন্ত্রীই যে শেষ পর্যন্ত আসল সমস্যা চিহ্নিত করলেন, সে কথা বিকাশ মানছেন না। তিনি বলছেন, ‘‘এটা আসলে কংগ্রেসের পাল থেকে হাওয়া কাড়ার চেষ্টা। ভোটার তালিকায় গরমিলের অভিযোগ কংগ্রেস সবার আগে তুলেছে। কংগ্রেসের সেই বক্তব্য গোটা দেশে বিশ্বাসযোগ্যতা পাচ্ছিল। তাই পশ্চিমবঙ্গে সেই হাওয়াটা মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় নিজের পালে টানার চেষ্টা করলেন।’’
বিজেপির দাবি, কমিশনের বক্তব্যে কোনও ‘অস্বাভাবিকতা’ নেই। রাজ্য বিজেপির তরফে নির্বাচন কমিশনের সঙ্গে যোগাযোগ রাখার দায়িত্বপ্রাপ্ত নেতা শিশির বাজোরিয়া বলছেন, ‘‘একই নম্বরের ভোটার পরিচয়পত্র দুটো আলাদা আলাদা রাজ্যে থাকা একেবারেই অস্বাভাবিক নয়। ভোট তো অনলাইনে হয় না যে, এক রাজ্যের ভোটার তাঁর পরিচয়পত্রের নম্বর মিলে যাওয়ার সুবাদে ঘরে বসে বসে বিভিন্ন রাজ্যে ভোট দিয়ে দিতে পারবেন। কার্ডটা হাতে নিয়ে ভোটকেন্দ্রে গিয়েই তো তাঁকে ভোট দিতে হবে। গুজরাতের ভোটার পশ্চিমবঙ্গে এসে ভোট দেবেন কী ভাবে? তাঁর কার্ডে তো গুজরাতের একটি বিধানসভা কেন্দ্রের নাম লেখা থাকবে। কার্ড কেউ পড়ে দেখবে না, এই ভরসায় কেউ গুজরাত থেকে বাংলায় কি ভোট দিতে চলে আসতে পারবেন?’’
বাড়ি বাড়ি গিয়ে স্ক্রুটিনি করার যে সিদ্ধান্ত তৃণমূল নিয়েছে, তা নিয়ে বিজেপির কোনও আপত্তি নেই। এমনকি নির্বাচন কমিশন ভোটার পরিচয়পত্রের নম্বর সংশোধন করতে চাইলেও বিজেপির আপত্তি নেই বলে শিশির জানিয়েছেন। তাঁর কথায়, ‘‘কমিশন যদি নির্বাচন ব্যবস্থাকে আরও ত্রুটিমুক্ত করার জন্য কিছু করতে চায়, করুক। আমাদের কোনও আপত্তি নেই।’’