রক্ষণাবেক্ষণের অভাবে মরে গিয়েছে আগে লাগানো গাছ। মেদিনীপুরের খয়রুল্লাচকে।
বাম-আমলে নাম ছিল ‘অরণ্য সপ্তাহ’। তৃণমূল আমলে তাই হয়েছে ‘বনমহোত্সব’। উদ্দেশ্য একই— সবুজ বাড়িয়ে পরিবেশ বাঁচানো। আর সেই লক্ষ্যেই আজ, মঙ্গলবার থেকে শুরু হচ্ছে এ বারের বনমহোৎসব। গোটা রাজ্যের সঙ্গে জঙ্গলমহলের জেলা পশ্চিম মেদিনীপুরেও নানা অনুষ্ঠান হবে। বুধবার জেলা স্তরের মূল অনুষ্ঠানটি হওয়ার কথা সাঁকরাইলে।
কিন্তু এ সবের মধ্যেই সবুজ বাড়ানোর উদ্দেশ্য প্রশ্নের মুখে পড়ছে। কারণ, প্রতি বার নতুন করে গাছ লাগানো হলেও যথাযথ রক্ষণাবেক্ষণের অভাবে চারাগাছগুলি নষ্ট হয়ে যাচ্ছে। সবার অলক্ষ্যে ঝরে যাচ্ছে পাতা। সেই সঙ্গে উন্নয়নের নামে একের পর এক গাছে কোপ পড়ছে। কোথাও রাস্তা সম্প্রসারণের জন্য কোথাও আবার নতুন ভবন নির্মাণের জন্য কোপ পড়ছে গাছে। পাশাপাশি, রাতের অন্ধকারে গাছ কেটে পাচার তো রয়েছেই। বন দফতরের এক কর্তা মানছেন, ‘‘বন ধ্বংস হলে সমাজের ক্ষতি। মানুষের ক্ষতি। আমাদের সকলেরই উচিত, প্রাকৃতিক ভারসাম্য বজায় রাখতে সবুজকে বাঁচিয়ে রাখা।’’
কিন্তু নির্বিচারে গাছ কাটা চললে তো প্রাকৃতিক ভারসাম্য বিপন্ন হবে? খড়্গপুরের ডিএফও অঞ্জন গুহর অবশ্য দাবি, ‘‘গাছ কেটে কাঠ পাচারের প্রবণতা আগের থেকে কমেছে। মানুষ সচেতন হচ্ছে। অবৈধ ভাবে গাছ কাটার খবর পেলে উপযুক্ত পদক্ষেপ করা হয়।’’ তিনি আরও জানান, সবুজ বাড়াতে বন দফতর সব সময় সচেষ্ট। তবে কোথাও কোথাও উন্নয়নমূলক কাজের জন্য কিছু গাছ কাটার অনুমতি দিতে হয়। আর তা দেওয়া হয় সব দিক খতিয়ে দেখে। প্রায় একই বক্তব্য মেদিনীপুরের ডিএফও বিজয় সালিমঠ, রূপনারায়ণের ডিএফও অর্ণব সেনগুপ্তের। বিজয়বাবু বলেন, ‘‘বনমহোৎসবে এ বারও প্রচুর চারা বিতরণ করা হবে। সবুজ বাড়াতে নির্দিষ্ট পরিকল্পনা করা হয়েছে।’’ অর্ণববাবুর কথায়, ‘‘সবুজ বাড়লেই আমাদের চারপাশের পরিবেশ আরও সুন্দর হবে।’’
দোকানঘর তৈরির জন্য গাছ কাটা হয়েছে জেলা পরিষদ চত্বরে।
জঙ্গলমহলের এই জেলায় একটা সময় অশান্তির জেরে প্রচুর গাছ কাটা পড়েছে। এক শ্রেণির অসাধু ব্যবসায়ী যথেচ্ছ গাছ কেটে পাচার করেছে। তখন জঙ্গলমহলের বিস্তীর্ণ এলাকায় বন সুরক্ষা কমিটির সদস্যরা কাজ করতে পারেননি। ফলে, ঠিক মতো নজরদারি চালানো সম্ভব হয়নি। জঙ্গলে শাল, ইউক্যালিপটাসের সংখ্যা হু হু করে কমেছে। রাজ্যে পালাবদলের পরে জঙ্গলমহল এখন শান্ত। তবে সবুজ ধ্বংসের ছবিটা বিশেষ বদলায়নি বলেই অভিযোগ। এখনও গাছ কেটে পাচার করা হয়। সক্রিয় অসাধু ব্যবসায়ীরা। আগে সিপিএম নেতাদের সঙ্গে তাদের ওঠাবসা ছিল। এখন সখ্য তৃণমূল নেতাদের সঙ্গে। ফলে, তেমন বাধার মুখেও পড়তে হয় না। কেন এখনও গাছ পাচার ঠেকানো গেল না? সদুত্তর এড়িয়ে বন দফতরের এক কর্তা বলেন, ‘‘অভিযোগ পেলে বা বিষয়টি জানলে ব্যবস্থা যে নেওয়া হয় না তা নয়। অসাধু ব্যবসায়ীদের বিরুদ্ধে কড়া পদক্ষেপই করা হয়।’’
রাজ্যে পালাবদলের পরে তৃণমূল সরকার জঙ্গলমহলকে তার পুরনো চেহারা ফিরিয়ে দিতে উদ্যোগী হয়েছিল। নতুন গাছ লাগানোর ক্ষেত্রে এই এলাকাকে বাড়তি গুরুত্ব দেওয়া হয়। ঠিক হয়েছিল, সমস্ত খাল, নদীর পাড়ে গাছ লাগানো হবে। তবে সেই উদ্যোগ কতটা ফসপ্রসূ হয়েছে, তা নিয়ে প্রশ্ন রয়েছে।
পাশাপাশি উন্নয়নের নামেও যথেচ্ছ বৃক্ষচ্ছেদ চলছে। পশ্চিম মেদিনীপুর জেলা পরিষদ চত্বরে দোকানঘর তৈরির জন্য সীমানা এলাকায় বেশ কিছু গাছ কাটা হয়েছে। এর মধ্যে কয়েকটি গাছের বয়স ৫০ বছরের বেশি। জেলা পরিষদের সভাধিপতি উত্তরা সিংহ অবশ্য বলেন, ‘‘গাছগুলো না কাটলে দোকানঘরের জন্য উপযুক্ত জায়গা পাওয়া যাচ্ছিল না। যে সংখ্যক গাছ কাটা হয়েছে, তার চারগুণ গাছ জেলা পরিষদ চত্বরেই লাগানো হবে।’’
কেশপুরে আবার প্রায় তিন হাজার গাছ কাটা পড়েছে রাস্তা সম্প্রসারণের জন্য। একটি রাস্তা সম্প্রসারণের সিদ্ধান্ত হয়েছে। অন্য একটির সিদ্ধান্ত আগামী দিনে হবে। এ ক্ষেত্রেও রাস্তার দু’পাশে থাকা গাছ কাটা হচ্ছে। বেশির ভাগই ইউক্যালিপটাস। কেশপুরের বিডিও মহম্মদ জামিল আখতার যদিও বলেন, ‘‘রাস্তা সম্প্রসারণের কাজ শেষ হয়ে গেলে রাস্তার পাশে ফের গাছ লাগানো হবে।’’
এই সব গাছ কাটার মধ্যেই বনমহোৎসবে নতুন গাছ লাগানোর পরিকল্পনা করেছে বন দফতর। ঠিক হয়েছে, মেদিনীপুর বন বিভাগ ৮২০ হেক্টর জমিতে গাছ লাগাবে। সব মিলিয়ে ১৪ লক্ষ চারা লাগানো হবে। রূপনারায়ণ বন বিভাগ ৫৬০ হেক্টর জমিতে গাছ লাগানোর পরিকল্পনা করেছে। চারা লাগানো হবে ৯ লক্ষ। খড়্গপুর বন বিভাগ ৬০০ হেক্টর জমিতে ১০ লক্ষ চারাগাছ লাগানোর পরিকল্পনা করেছে। যে সব গাছের চারা লাগানো হবে, তার মধ্যে রয়েছে মূলত শাল, ইউক্যালিপটাস, মহুল, অর্জুনি, আকাশবনি প্রভৃতি। পাশপাশি, আম, পেয়ারা, কাঁঠাল, পেপে প্রভৃতি চারা বিতরণ হওয়ার কথা। জেলা জুড়ে যে ৩৩ লক্ষ চারা লাগানো হবে, তার সঠিক দেখভাল হবে তো, না কি অনান্য বছরের মতো লাগানো চারার একটা ভাল অংশই রক্ষণাবেক্ষণের অভাবে ঝরে যাবে, প্রশ্নের উত্তর দেবে সময়ই।
ছবি তুলেছেন রামপ্রসাদ সাউ।