বিমল রায়
বহুজাতিক সংস্থার সিইও থেকে শুরু করে দেশি-বিদেশি বিভিন্ন প্রসিদ্ধ প্রতিষ্ঠানের বিশিষ্ট শিক্ষাবিদ। প্রতিবাদের ছাতার নীচে সকলে একজোট। আর্থিক অনিয়মের অভিযোগ তুলে ইন্ডিয়ান স্ট্যাটিস্টিক্যাল ইনস্টিটিউট (আইএসআই)-এর ডিরেক্টরের পদ থেকে বিমল রায়কে যে ভাবে সরানো হয়েছে, ওঁদের প্রতিবাদ তারই বিরুদ্ধে। যার রেশ খোদ প্রধানমন্ত্রীর দরবারে পৌঁছে দেওয়ারও উদ্যোগ শুরু হয়েছে।
আইএসআইয়ের অধিকর্তার পদে বিমলবাবুর মেয়াদ শেষ হওয়ার কথা আগামী ৩১ জুলাই। তার আগেই ওঁর যাবতীয় ক্ষমতা কেড়ে তুলে দেওয়া হয়েছে পরবর্তী ডিরেক্টর হিসেবে নির্বাচিত সঙ্ঘমিত্রা বন্দ্যোপাধ্যায়ের হাতে। আর্থিক অনিয়মে অভিযুক্ত হয়ে বিমলবাবু আপাতত শুধু খাতায়-কলমেই ডিরেক্টর। পরিসংখ্যান মন্ত্রকের আশঙ্কা, বিমলবাবু আরও দু’মাস ক্ষমতায় থাকলে আরও দুর্নীতি হতে পারে। তবে গত মঙ্গলবার মন্ত্রকের নতুন নির্দেশিকায় বিমলবাবুকে আইএসআইয়ের সাঙ্কেতিক ভাষা কেন্দ্রের (ক্রিপ্টোলজি সেন্টার) প্রধানের দায়িত্ব দিয়ে সেন্টারের আর্থিক-প্রশাসনিক ক্ষমতা দেওয়া হয়েছে।
এ দিকে কর্মসূত্রে আইএসআইয়ের প্রাক্তনীরা ছড়িয়ে রয়েছেন বিশ্বের প্রান্তে প্রান্তে। প্রাক্তনী বাদ দিলেও খ্যাতনামা বহু শিক্ষাবিদ কোনও না কোনও ভাবে আইএসআইয়ের সঙ্গে জড়িত। ঐতিহ্যবাহী প্রতিষ্ঠানটিতে এ হেন নজিরবিহীন ঘটনাপ্রবাহ তাঁদের মহলে আলোড়ন ফেলেছে। যার সুবাদে বিমলবাবুর ক্ষমতাচ্যুতির সংবাদ কার্যত পেয়ে গিয়েছে আন্তর্জাতিক মাত্রা।
আলোড়ন এ বার দানা বেঁধেছে প্রতিবাদে। যে ভাবে একতরফা সিদ্ধান্তে বিমলবাবুকে সরানো হল, ওঁরা সেটা মানতে পারছেন না। বহুজাতিক সংস্থার সিইও, গুগ্ল-এর সিনিয়র অফিসার, কিংবা মিশিগান-বার্কলের মতো বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপকেরা অনেকেই বিমলবাবুর সমর্থনে সই সংগ্রহে নেমেছেন। ঠিক হয়েছে, স্বাক্ষরিত প্রতিবাদপত্র তুলে দেওয়া হবে প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদীর হাতে। আইএসআই-সূত্রের খবর: প্রতিষ্ঠানের শিক্ষক-পড়ুয়াদের একাংশও এই উদ্যোগে সামিল। যদিও কর্তৃপক্ষের রোষে পড়ার ভয়ে তাঁরা সামনে আসতে চাইছেন না।
বার্কলে বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক, অর্থনীতিবিদ প্রণব বর্ধন আইএসআইয়েও পড়িয়ে গিয়েছেন। বিমল-কাণ্ডে তিনি উদ্বিগ্ন। ‘‘যথেষ্ট প্রমাণ না-দেখিয়ে মাত্র দেড় মাস আগে যে ভাবে ওঁকে সরানো হল ও নানা কটু ইঙ্গিতে চরিত্র হনন করা হল, তা মেনে নেওয়া যায় না।’’— বলছেন তিনি। প্রণববাবুর পর্যবেক্ষণ, ‘‘অভিযুক্তকে প্রকাশ্যে আত্মপক্ষ সমর্থনের যথেষ্ট সুযোগ না-দিয়ে কর্তৃপক্ষ স্বেচ্ছাচার করেছেন। এটা কুরুচিপূর্ণ। শিক্ষা-জগতে রাজনৈতিক ও আমলাতান্ত্রিক জবরদস্তির নিকৃষ্ট দৃষ্টান্তও বটে।’’ আইএসআইয়ের প্রাক্তন ছাত্র শিবব্রত রায় এখন গুগ্লের পদস্থ কর্তা। তাঁর প্রশ্ন, ‘‘বিমলবাবু অন্যায় করে থাকলে শাস্তি হোক। কিন্তু এটা কী পদ্ধতি?’’
একই সুর আরও অনেকের গলায়। কর্মসূত্রে আইএসআইয়ের সঙ্গে জড়িত থাকার সুবাদে বিমলবাবুর সঙ্গে ব্যক্তিগত আলাপ রয়েছে অর্থনীতিবিদ মৈত্রীশ ঘটকের। তিনি বলেন, ‘‘বিমলবাবু আইএসআই-কে অন্য উচ্চতায় নিয়ে যাওয়ার চেষ্টা করছিলেন। প্রতিষ্ঠানের ভিতরকার ব্যাপারে মন্তব্য করতে চাই না। কিন্তু যে ভাবে, যে সব কারণ দেখিয়ে ওঁর মতো কৃতী মানুষকে সরানো হল, তাতে আহত বোধ করছি।’’ অক্সফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক দেবোপম ভট্টাচার্য আইএসআইয়ে পড়েছেন। ‘‘ইনস্টিটিউটকে আত্মনির্ভর ও আন্তর্জাতিক গবেষণা প্রতিষ্ঠানে পরিণত করার লক্ষ্যে বিমলবাবুর নতুন ভাবনাচিন্তা ছিল। এমন পরিশ্রমী ও দূরদৃষ্টিসম্পন্ন লোকের নামে উৎকট অপপ্রচার হলে প্রতিষ্ঠানেরই ক্ষতি,’’ মন্তব্য তাঁর। আর বিমলবাবুর প্রতিক্রিয়া, ‘‘আমার পক্ষে এত প্রাক্তনী রয়েছেন জেনে দারুণ লাগছে!’’
জানা গিয়েছে, আগামী পাঁচ বছরের সম্ভাব্য ডিরেক্টর হিসেবে যে ছ’জনের নাম উঠে এসেছিল, তাঁদের মধ্যে বিমলবাবু ও সংঙ্ঘমিত্রাদেবী, দু’জনেই ছিলেন। প্রাক্তনী মহলের একাংশের দাবি: আইএসআই পরিচালন কাউন্সিলের অনেক সদস্য বিমলবাবুকে পরবর্তী ডিরেক্টর হিসেবে চেয়েছিলেন। ডিরেক্টর নির্বাচনের জন্য গত ২৩ এপ্রিল বেঙ্গালুরুতে আয়োজিত কাউন্সিলের বৈঠকে ওঁদের অনেকে বিমলবাবুর হয়ে সওয়াল করেন। সর্বসম্মতিক্রমে কেউ মনোনীত না-হলে ভোটাভুটি হওয়ার কথা। কিন্তু ভোট হলে বিমলবাবু জিতে যেতে পারেন, এই আশঙ্কায় সে দিন বৈঠক ভেস্তে দেওয়া হয় বলে অভিযোগ।
এবং অভিযোগের তির মূলত আইএসআই পরিচালন কাউন্সিলের চেয়ারম্যান অরুণ শৌরির দিকে। কাউন্সিল বৈঠকে অনিয়মের অভিযোগ তুলে ইতিমধ্যে কলকাতা হাইকোর্টে একটি মামলাও দাখিল করেছেন প্রাক্তনীদের একাংশ। যাঁদের দাবি, বিধির তোয়াক্কা না-করে সংঙ্ঘমিত্রাদেবীকে বিমলবাবুর স্থলাভিষিক্ত করা হয়েছে।
অরুণ শৌরির কী বক্তব্য?
তাঁর যুক্তি: আইএসআইয়ের ইতিহাসে এ যাবৎ প্রশান্ত মহলানবিশ ছাড়া কারও মেয়াদ বাড়ানো হয়নি। এটাই রীতি। সেই মতো নতুন ডিরেক্টর বাছাইয়ের জন্য বেণুগোপাল রেড্ডি ও গোবর্ধন মেটাকে নিয়ে কমিটি গড়া হয়। ‘‘কমিটিতে আমিও ছিলাম। বিমল রায়-সহ ছ’জনকেই ডাকা হয়েছিল। এক ঘণ্টা করে প্রত্যেকের ইন্টারভিউ হয়।’’— বলেন শৌরি। তাঁর দাবি, সব প্রার্থীর যাবতীয় যোগ্যতা বিচার করেই পরবর্তী ডিরেক্টর হিসেবে সঙ্ঘমিত্রাদেবীকে বেছে নেওয়া হয়।
কিন্তু কাউকে দ্বিতীয় বার ডিরেক্টর করার রেওয়াজ না থাকা সত্ত্বেও বিমলবাবুর নাম বিবেচনায় এসেছিল কেন?
শৌরির ব্যাখ্যা, ওঁকে ফের রাখা নিয়ে একটা দাবি ছিল। ‘‘যে ক’জনের নাম এসেছে, তাঁদের কেউ যদি বিমল রায়ের চেয়ে যোগ্যতর না-হতেন তখন কি প্রতিষ্ঠানকে বঞ্চিত করা হতো?’’— প্রশ্ন করে শৌরি বলেন, ‘‘দেখা গিয়েছে, এই পদের জন্য সঙ্ঘমিত্রা বন্দ্যোপাধ্যায়ের যোগ্যতা বিমল রায়ের তুলনায় ঢের বেশি। সঙ্ঘমিত্রার ১৪৯টি টেকনিক্যাল পেপার রয়েছে। বিমলবাবুর ৪০টি। সঙ্ঘমিত্রা ভাটনাগর পুরস্কারও পেয়েছেন।’’ পাশাপাশি বিমলবাবুর বিরুদ্ধে পাল্টা অভিযোগও তুলেছেন শৌরি। কী রকম?
ওঁর দাবি: নয়া ডিরেক্টর নির্বাচনের বৈঠকে কার্যবিবরণীতে ডিরেক্টরের সই করার প্রথা থাকলেও বিমল রায় করেননি। পরেও নানা বিষয়ে তিনি নানান অজুহাত দেখিয়েছেন। আইএসআই প্রেসিডেন্ট সি রঙ্গরাজনকে ব্যাপারটা জানানোর কথা ভাবা হয়। তারই মধ্যে কেন্দ্রীয় মন্ত্রকের দু’টি সিদ্ধান্ত— আর্থিক অনিয়মের অভিযোগের প্রেক্ষিতে বিমলবাবুর ক্ষমতা কেড়ে নেওয়া ও তাঁকে ক্রিপ্টোলজি সেন্টারের দায়িত্ব প্রদান।
কিন্তু যাঁর বিরুদ্ধে আর্থিক দুর্নীতির অভিযোগের তদন্ত শেষ হল না, তাঁকে আবার একটি সেন্টারের প্রধান করে আর্থিক ক্ষমতা দেওয়া হল কী ভাবে?
শৌরির দাবি, এ সম্পর্কে সরকারি সিদ্ধান্ত গ্রহণের আগে তাঁর সঙ্গে কোনও আলোচনা হয়নি। ‘‘আমি অন্ধকারে ছিলাম। আইন মোতাবেক সরকারের এই এক্তিয়ার আছে। কিন্তু কেন এটা করা হল, তা সরকারই বলতে পারবে।’’— বলেন তিনি। শৌরির কথায়, ‘‘বিষয়টি ইতিমধ্যে আদালতে গিয়েছে। সেখানে নিশ্চয় সব কিছু খোলসা হবে।’’
সঙ্ঘমিত্রাদেবী অবশ্য এ প্রসঙ্গে কোনও মন্তব্য করতে চাননি।