—প্রতীকী ছবি।
দক্ষিণ এশিয়ার মধ্যে বাংলাদেশ সবচেয়ে বেশি প্রাকৃতিক দুর্যোগের দেশ। বন্যা ও ঘূর্ণিঝড়ের কারণে বাংলাদেশের নিচু এবং উপকূলীয় এলাকার কৃষি ও জনজীবন নিয়ে দীর্ঘ দিন ধরেই শঙ্কা প্রকাশ করছেন বিজ্ঞানীরা।
২০১৮-১৯ সালেও একাধিক দুর্যোগের জেরে বাংলাদেশের ৭১০ কিলোমিটার উপকূল এলাকায় সব মিলিয়ে ১.৪ মিলিয়ন হেক্টর জমিতে নোনা জল প্রবেশ করায় উন্মুক্ত জলাশয়গুলি ও ভূগর্ভস্থ জলের উৎস লবণাক্ত হয়ে যায়। চার বছরেই সেই ছবিটা বদলেছে অপ্রত্যাশিত ভাবে।
বাংলাদেশের সুন্দরবন ঘেঁষা লবণ প্রভাবিত উপকূলীয় অঞ্চলে প্রথাগত চাষে ঝুঁকি কমানো এবং লাভজনক শস্য চাষের খেত বাড়াতে ২০১৫ সাল থেকেই যুদ্ধকালীন পদ্ধতিতে চাষিদের নিয়ে অনুশীলন শুরু করেছিল অস্ট্রেলিয়া সরকারের জাতীয় বিজ্ঞান গবেষণা সংস্থা ‘কমনওয়েলথ সায়েন্টিফিক অ্যান্ড ইন্ডাস্ট্রিয়াল রিসার্চ’ ও বাংলাদেশ সরকারের কৃষি গবেষণা ফাউন্ডেশন। বঙ্গোপসাগরের তটরেখা বরাবর খুলনা, বরিশাল, যশোর-সহ ১৯টি জেলার ২২ শতাংশ প্রথাগত চাষের জমিতে দু’বার ধান ও মাঝে এক বার সর্ষে চাষ এবং বাকি ৭০ শতাংশ হাওর, বিল ও অবশিষ্ট পতিত জমিতে মাচা করে বিভিন্ন আনাজ ফলানো হচ্ছে। ভাসমান আনাজ চাষও মডেল হয়েছে এই এলাকায়।
কমনওয়েলথ সায়েন্টিফিক অ্যান্ড ইন্ডাস্ট্রিয়াল রিসার্চ-এর প্রজেক্ট লিডার বিজ্ঞানী মহম্মদ মৈনুদ্দিন, অস্ট্রেলিয়ান সেন্টার ফর ইন্টারন্যাশনাল এগ্রিকালচারাল রিসার্চ-এর প্রকল্প নির্দেশক নীল লজ়ারো ও দক্ষিণ এশিয়ার আঞ্চলিক ব্যবস্থাপক প্রতিভা সিংহ সম্প্রতি খুলনায় একটি কর্মশালায় বাংলাদেশের সুন্দরবন উপকূলে ১২৫ কিলোমিটার বর্গাকার লবণাক্ত জমিতে গত আট বছরে চাষিদের শস্য নিশ্চয়তার সাফল্য তুলে ধরেন। মৈনুদ্দিন ও নীলের কথায়, ‘‘সব থেকে সাফল্য এসেছে পতিত জমিতে চাষের ক্ষেত্রে। ১৭ রকমের মিষ্টি আলু, মাচার হরেক রকম আনাজ, ন’রকম বাদাম, চার ধরনের বাতাবি লেবু-সহ আমন ও বোরো ধান এবং মাঝের সময়টা সর্ষে ফলছে। চাষিরা দিনের শেষে লাভ দেখতে চান কিন্তু তাঁদের পরিবর্তিত জলবায়ুর সঙ্গে চাষের পদ্ধতিতে পরিবর্তন আনায় অভ্যস্ত হতে অনেকটা সময় লাগে। তা এ ক্ষেত্রে খুব কম সময়েই হয়েছে।’’
কৃষি নির্ভর বাংলাদেশে উপকূল এলাকায় ঘন ঘন দুর্যোগের কারণেই লবণাক্ত হওয়ার ছবিটার যে আমূল পরিবর্তন হয়েছে, তা মানছেন সে দেশের কৃষিমন্ত্রী মহম্মদ আব্দুর রজ্জাকও। তিনি নিজেও কৃষি বিজ্ঞানী। খুলনা বিশ্ববিদ্যালয়ের একটি সভায় তিনি বলেন, ‘‘উপকূলীয় লবণাক্ত অঞ্চলে একাধিক ফসল উৎপাদনের কৌশল উদ্ভাবন করছেন গবেষক, বিজ্ঞানীরা। এতে বাংলাদেশে কৃষি উৎপাদনে আর একটি বিপ্লব ঘটানোর সম্ভাবনা তৈরি হয়েছে। তবে প্রযুক্তিতে আরও উন্নত হতে হবে।’’
প্রযুক্তি সহায়তায় এগিয়ে এসেছে প্রতিবেশী দেশ ভারত। দুই দেশের উপকৃল ঘেঁষা সুন্দরবনে স্যাটেলাইটের মাধ্যমে জিআইএস ও রিমোট সেন্সিং প্রযুক্তি ব্যবহার করে লবণাক্ত জমিগুলিকে সুপরিকল্পিত ভাবে চাষযোগ্য করার কাজ প্রায় শেষের পথে বলে জানান বিজ্ঞানী মনোজকুমার নন্দ। ভারতের বিধানচন্দ্র কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়, নরেন্দ্রপুর রামকৃষ্ণ মিশন বিবেকানন্দ বিশ্ববিদ্যালয়, ক্যানিং-এর সিএসএসআরআইও এই প্রকল্পে সংযুক্ত হয়েছে।
বাংলাদেশ কৃষি গবেষণা কাউন্সিলের চেয়ারম্যান শেখ মহম্মদ বখতিয়ার বলেন, ‘‘ফসল উৎপাদনে গত চার-পাঁচ বছরে অনেকটাই এগিয়েছে উপকূল এলাকা। দেশের ১৩টি সংস্থা ও পাঁচটি মন্ত্রক একযোগে এ নিয়ে কাজ করছে এখন। তবে শস্য সংরক্ষণের জন্য হিমঘরের অভাব আছে।’’ চলতি অর্থবর্ষে দেশের পরিকল্পনা মন্ত্রক কৃষি খাতে সাত হাজার কোটি টাকা বরাদ্দ করেছে ও ৪০ হাজার কোটি টাকা কৃষি মন্ত্রক বরাদ্দ করেছে বলে জানালেন কৃষি গবেষণা ফাউন্ডেশনের নির্দেশক মহম্মদ আক্কাশ আলি।
খুলনার বটিয়াঘাটা উপজেলার খুনা গ্রামে বাংলাদেশ ধান গবেষণা ইনস্টিটিউটের উদ্যোগে কয়েকশো হেক্টর জমিতে খরিফ ধান ব্রি-৮৭ চাষ করে এ বার খুশি স্থানীয় চাষিরা। ওই চাষিদের বেশ কয়েক জন খেত ঘুরিয়ে দেখানোর সময় বলেন, ‘‘অনেক বছর পরে এখানকার জমিও প্রাণ পেয়েছে যেন। একটুকরো চিরসবুজ বাংলাদেশ গড়তে পেরেছি আমরা।’’