নেতাজি ভবনে রণেন সেন। সোমবার। ছবি: দেবস্মিতা ভট্টাচার্য।
বাইরের সমস্যার মোকাবিলা করতে গেলে ঘর সামলাতে হবে ভারতকে। সোমবার সন্ধ্যায় নেতাজি ভবনে তৃতীয় বর্ষের ‘কৃষ্ণা বসু স্মারক বক্তৃতা’য় এই অভিমতই প্রকাশ করলেন দেশের শীর্ষস্তরের অবসরপ্রাপ্ত কূটনীতিক রণেন সেন। তিনি বলেন, “জাতীয় সুরক্ষা, প্রতিরক্ষা, বিদেশ নীতি— সবই আদতে অর্থনৈতিক বিকাশ ও সামাজিক, রাজনৈতিক ঐক্য তথা বহুত্বের সমন্বয়ের সঙ্গে জড়িত। জগৎসভায় নিজেদের মেলে ধরতে ভারতকে চিনের সঙ্গে তার সার্বিক শক্তির ফারাক কমাতেই হবে।”
‘ভারত ও প্রধান বিশ্ব শক্তিগুলি’ শীর্ষক বক্তৃতায় কূটনীতিক হিসেবে বিভিন্ন দেশে নিজের পাঁচ দশকের অভিজ্ঞতাই এ দিন শুনিয়েছেন রণেন। কিন্তু এর মধ্যে থেকেই আজকের বিশ্ব পরিস্থিতি বা দুনিয়ার সামনে উদ্ভূত নানা সঙ্কটের ছবিটাও উঠে আসে। রণেনের মতে, “গত কয়েক বছরে ভারতের জন্য বিশ্ব পরিস্থিতির সব থেকে তাৎপর্যপূর্ণ বদল হল রাশিয়া এবং চিনের মধ্যে পারস্পরিক কৌশলগত সমন্বয়।”
এ প্রসঙ্গে আমেরিকা ও ভারতের রসায়নের কথা মেলে ধরে রণেনের বক্তব্য, “চিন-ভারত ও পাকিস্তান-ভারত সম্পর্কের ক্ষেত্রে আমেরিকান প্রশাসন অতীতে ও বর্তমানে ভারতের প্রতি বন্ধুভাবাপন্ন বলে মনে হতে পারে। কিন্তু চিনের প্রবল প্রতাপের সামনে আমেরিকা বড়জোর ভারতকে ঠেকনা হিসেবে ব্যবহার করবে, কখনওই চিনের বিরুদ্ধে সরাসরি সামরিক সংঘাতে জড়াবে বলে মনে হয় না।” অতীতে আমেরিকায় ভারতের রাষ্ট্রদূত হিসেবে দু’দেশের মধ্যে কৌশলগত সমন্বয় তথা পরমাণু চুক্তি স্বাক্ষর পর্বে এক জন গুরুত্বপূর্ণ কুশীলব ছিলেন রণেন।
ভারতের দুর্বলতা নিয়ে এ দিন অকপটে মুখ খোলেন প্রাক্তন রাষ্ট্রদূত। তিনি বলেন, “এত বছরেও ভারতে গৃহীত মানচিত্রটি বিশ্বের কোনও প্রধান দেশেরই স্বীকৃতি পায় না। ভারত ও চিনের সীমান্ত স্বচ্ছ ও স্পষ্ট নয়। বিভিন্ন দিকেই মানচিত্রের সঙ্গে প্রকৃত নিয়ন্ত্রণরেখার ফারাক আছে।” উচ্চ পর্যায়ে নিরন্তর আলোচনায় পারস্পরিক সমঝোতার মধ্যেই ভারতকে চিনের সঙ্গে তাদের পুরনো সমস্যার সমাধান খুঁজতে হবে বলেও মনে করেন রণেন।
নেতাজি রিসার্চ বুরোর কর্তা তথা লন্ডন স্কুল অব ইকনমিক্সের রাষ্ট্রবিজ্ঞানের অধ্যাপক সুমন্ত্র বসুর (কৃষ্ণা বসুর ছোট ছেলে) প্রশ্নের জবাবে এ দিন রণেন বলেন, “অদূর ভবিষ্যতে ইউক্রেনে যুদ্ধ থামবার কোনও সমাধানসূত্র চোখে পড়ছে না। দু’দেশের সঙ্কটের বীজ সোভিয়েট ইউনিয়ন ভাঙার সময়েই মালুম হয়েছিল। ২০২৩-এ ভারতকে রুশ-ইউক্রেন যুদ্ধের বিশ্বজনীন অভিঘাত মাথায় রেখেই যাবতীয় পদক্ষেপ করতে হবে।” সেই সঙ্গে তিনি বলেন, “ভারত সাধারণত স্থিতাবস্থাকামী শক্তি হিসেবে পরিচিত। হুটহাট অবস্থান না নিয়ে ঠান্ডা মাথায় সংলাপ চালিয়ে যাওয়ার পরিস্থিতি ভারতকে বজায় রাখতে হবে। দেখতে হবে, কীভাবে নিজেদের জন্য ইতিবাচক সাড়া ফেলা সম্ভব।”
তবে আন্তর্জাতিক শক্তি হিসেবে নিজেদের মেলে ধরতে ভারতের জন্য রণেনের মতে একটাই দাওয়াই রয়েছে। তাঁর কথায়, “জাতীয় নিরাপত্তার স্বার্থে আমাদের অর্থনৈতিক উন্নয়ন এবং সামাজিক সংহতি ও সঙ্ঘবদ্ধতাই হল চাবিকাঠি।” প্রয়াত কৃষ্ণা বসুর সাংসদ জীবনের পরম সুহৃদ রণেন। সুভাষচন্দ্র বসুর ভ্রাতুষ্পুত্র-বধূর ৯২ বছরের জন্মদিনে তাঁর বড় ছেলে তথা নেতাজি রিসার্চ বুরোর অধিকর্তা ইতিহাসবিদ সুগত বসু কৃষ্ণার ইংরেজি ও বাংলা রচনাসম্ভার এবং এ বছর প্রকাশিত ‘নেতাজি আ লাইফ ইন পিকচার্স’ বইটি রণেনের হাতে তুলে দেন।