আনুষ্ঠানিক ভাবে তৃণমূলে ফিরলেন বনগাঁ পুরসভার চার কাউন্সিলর। —নিজস্ব চিত্র
অনাস্থার উপরে ভোটাভুটি রুখতে চূড়ান্ত অনিয়মের অভিযোগ উঠেছিল। তার জেরে হাইকোর্টে জোরদার ভর্ৎসনার মুখে পড়েছিল সরকার। স্বাভাবিক ভাবেই মুখ পুড়েছিল তৃণমূলেরও। যে বনগাঁ পুরসভার ঘটনা নিয়ে ওই অস্বস্তির মুখ দেখতে হয়েছিল, সেই বনগাঁতেই এ বার বিজেপির মুখ পুড়িয়ে দেওয়ার বন্দোবস্ত করল রাজ্যের শাসক দল। দলত্যাগী ৪ কাউন্সিলর তৃণমূলে ফিরলেন বৃহস্পতিবার। এ রাজ্যে তৃণমূলের সঙ্গে এঁটে উঠতে বিজেপি কতটা প্রস্তুত, সে প্রশ্ন আরও বড় আকার নিল বনগাঁয় এই ‘ঘর ওয়াপসি’র সৌজন্যে।
লোকসভা নির্বাচনের পরে ঢল নেমেছিল পুরসভার হাতবদলের। যে সব আসনে হেরেছে তৃণমূল, মূলত সেই সব এলাকা থেকেই একের পর এক পুরসভার সংখ্যাগরিষ্ঠ কাউন্সিলররা বিজেপিতে নাম লেখাতে শুরু করেছিলেন। মুকুল রায়ের খাসতালুক তথা অর্জুন সিংহের নির্বাচনী ক্ষেত্র ব্যারাকপুরেই সবচেয়ে প্রবল ছিল সেই প্রবণতা। ভাটপাড়া, নোয়াপাড়া, কাঁচরাপাড়া, হালিশহর, নৈহাটি— ওই এলাকার ৫ পুরসভার সংখ্যাগরিষ্ঠ কাউন্সিলরকে দলবদল করিয়েছিল বিজেপি।
এ ছাড়া দার্জিলিং, গঙ্গারামপুর, বনগাঁতেও টলে গিয়েছিল পুরসভার ভারসাম্য। টলমল করতে শুরু করেছিল হরিণঘাটা পুরসভাও।
শহরে-মফস্সলে এই দলবদলের সংখ্যা যত বাড়ছিল, আস্ফালনও ততই বাড়ছিল বিজেপির। কলকাতায় নয়, একেবারে দিল্লিতে সাংবাদিক সম্মেলন করে দাবি করা হচ্ছিল যে, পশ্চিমবঙ্গে তৃণমূল যুগের অবসান শুরু হয়ে গিয়েছে। বিজেপির সেই প্রচারটাই এ বার ব্যুমেরাং হয়ে ফিরছে। কাঁচরাপাড়া, হালিশহর, গঙ্গারামপুর এবং হরিণঘাটায় আগেই মুখ পুড়েছিল। দলত্যাগীদের অনেককেই ফের ঘরে ফিরিয়ে পুরসভাগুলিতে নিজেদের গরিষ্ঠতা সুনিশ্চিত করে ফেলেছিল তৃণমূল। বৃহস্পতিবার বনগাঁতেও একই কাণ্ড ঘটে গেল।
রাজ্যের পুরমন্ত্রী তথা তৃণমূল পুরদলের নেতা ফিরহাদ হাকিম এবং খাদ্যমন্ত্রী তথা উত্তর ২৪ পরগনা জেলা তৃণমূলের সভাপতি জ্যোতিপ্রিয় মল্লিক এ দিন বনগাঁর দলত্যাগী কাউন্সিলরদের ৪ জনকে নিয়ে সাংবাদিক সম্মেলন করলেন। ফিরহাদ দাবি করলেন, ‘জোর করে, মারধর করে, অত্যাচার করে, ভুল বুঝিয়ে, মিথ্যার আশ্রয় নিয়ে’ তৃণমূল কাউন্সিলরদের দলবদল করিয়েছিল বিজেপি।
আরও পড়ুন: সারদার টাকা ফেরত দিতে ইডি দফতরে শতাব্দী, ফের তলব রাজীব কুমারকে
বনগাঁয় দলবদল হওয়ার পরে তৃণমূলের পক্ষে ছিলেন ১০ কাউন্সিলর। আর বিজেপির সঙ্গে ছিলেন ১১ জন। কিন্তু এ দিন সেই ১১ জনের মধ্যে থেকে ৪ জন ঘরে ফেরায় তৃণমূলের সংখ্যা বেড়ে হল ১৪। বিজেপি কমে দাঁড়াল ৭-এ। অনাস্থা প্রস্তাবের উপরে যে ভোটাভুটি হওয়ার কথা রয়েছে বনগাঁয়, সেই ভোটাভুটি পর্যন্ত তৃণমূল যদি এই পরিস্থিতি ধরে রাখতে পারে, তা হলে চেয়ারম্যান পদে শঙ্কর আঢ্য যে টিকে যাবেন, তা নিয়ে কোনও সংশয় নেই।
বনগাঁয় সংখ্যাগরিষ্ঠতা না থাকা সত্ত্বেও জোর করে ক্ষমতা দখল করে রাখা নিয়ে চেয়ারম্যানকে তীব্র ভর্ৎসনা করেছিলেন কলকাতা হাইকোর্টের বিচারপতি সমাপ্তি চট্টোপাধ্যায়। বিচারপতির সেই পর্যবেক্ষণ বিজেপির জন্য খুব বড় হাতিয়ার হয়েছিল। কিন্তু বৃহস্পতিবার ৪ কাউন্সিলরকে ঘরে ফিরিয়ে চওড়া হাসি ফিরহাদের মুখে। তিনি বলেন, ‘‘এখন কী করে বলবে বনগাঁয় আমাদের সংখ্যাগরিষ্ঠতা নেই? কাউন্সিলররা তো আমাদের সঙ্গে। এখন তো থোঁতা মুখ ভোঁতা হবে।’’
আরও পডু়ন: ওয়াঘা সীমান্তে আটকে থাকার পর ভারতে ফিরল সমঝোতা এক্সপ্রেস
তবে বনগাঁ পুরসভায় অনাস্থা প্রস্তাবের উপরে ভোটাভুটি হওয়ার দিন যে দুই কাউন্সিলরকে ঢুকতে না দেওয়াকে কেন্দ্র করে উত্তপ্ত হয়ে উঠেছিল পরিস্থিতি, সেই হিমাদ্রি মণ্ডল এবং কার্তিক মণ্ডলকেই এ দিন তৃণমূলে স্বাগত জানিয়েছেন ফিরহাদরা। তৃণমূল ছেড়ে যাঁরা বিজেপিতে গিয়েছিলেন, তাঁদের মধ্যে এই হিমাদ্রি ও কার্তিকও ছিলেন। এঁদের বিরুদ্ধে অপহরণ, মুক্তিপণ আদায়-সহ বিভিন্ন ফৌজদারি ধারায় অভিযোগ আনা হয়েছিল। কলকাতা হাইকোর্ট তাঁদের গ্রেফতারিতে স্থগিতাদেশ দেয় যাতে তাঁরা অনাস্থার ভোটাভুটিতে অংশ নিতে পারেন। কিন্তু তাঁদের পুরসভায় ঢুকতে দেওয়া হয়নি সে দিন। হাইকোর্টের রায়ের প্রতিলিপি হাতে না পাওয়া পর্যন্ত তাঁদের ঢুকতে দেওয়া হবে না বলে জানানো হয়েছিল।
আগের দিন যে ২ কাউন্সিলরের বিরুদ্ধে এত বড় অভিযোগ তুলে তাঁদের গ্রেফতার করানোর চেষ্টায় ছিল তৃণমূল, ‘অপরাধী’ হিসেবে আগের দিন যাঁদের চিহ্নিত করার চেষ্টা হচ্ছিল, তাঁদেরই এ দিন সহাস্যে দলে স্বাগত জানানো হল কী ভাবে? এ প্রশ্নও কিন্তু তুলে দিয়েছে ফিরহাদ-জ্যোতিপ্রিয়র সাংবাদিক সম্মেলন।
তবে তৃণমূলের চেয়ে বিজেপির অস্বস্তি আপাতত অনেক বেশি বলেই মনে করছেন রাজনৈতিক বিশ্লেষকরা। দলবদল করানোর খেলায় নেমে যে ভাবে একের পর এক পুরসভায় ধাক্কার মুখে পড়ছে দল, তা নিয়ে বিজেপির অন্দরেও তোলপাড় শুরু হয়ে গিয়েছে। অন্যান্য দল থেকে কাউকে বিজেপিতে ঢুকতে দেওয়ার প্রশ্নে যাঁরা রক্ষণশীল, রাজ্য বিজেপির সেই অংশ আঙুল তুলছে মুকুল রায়ের দিকে। মুকুলের হাত ধরেই মূলত এই দলবদল শুরু হয়েছিল। দলের মুখ পোড়ার জন্য তাই অনেকে এখন মুকুলকেই দায়ী করতে চাইছেন।
অন্দর মহলে তোলপাড় হলেও মুকুল রায়ের বিরুদ্ধে প্রকাশ্যে কোনও মন্তব্য অবশ্য বিজেপির কেউ করছেন না। রাজ্য বিজেপির সাধারণ সম্পাদক সায়ন্তন বসু বলছেন, ‘‘যাঁরা তৃণমূলে ফিরছেন, তাঁরা তো তৃণমূল থেকেই আমাদের দলে এসেছিলেন। এ আর এমন কী ব্যাপার? বিভিন্ন জেলায় আমাদের টিকিটে জেতা পঞ্চায়েত সদস্য বা পঞ্চায়েত সমিতি সদস্যদের টেনে নিয়ে গিয়েছে তৃণমূল। পুরুলিয়ায় আমরা ৮টা পঞ্চায়েত সমিতি জিতেছিলাম। ভয় দেখিয়ে, মারধর করে, হামলা করে, পুলিশ-প্রশাসনকে ব্যবহার করে তার মধ্যে ৪টিতেই আমাদের বোর্ড গড়তে দেয়নি। তার ফলটা কী হয়, সেটা এ বারের লোকসভা ভোটে তৃণমূল বুঝতে পেরেছে।’’
বিজেপির দাবি, জোর করে, ভয় দেখিয়ে এবং পুলিশ-প্রশাসনকে ব্যবহার করে পুরসভাগুলো পুনরুদ্ধারের চেষ্টা করছে তৃণমূল। এর ফলে বিজেপির-ই লাভ হবে বলে দাবি করে মুখরক্ষা করতে চাইছেন তাঁরা।
প্রকাশ্যে বিজেপি নেতারা যা-ই বলুন, দলের অন্দরে কি মুকুল রায়ের দিকে আঙুল উঠছে না? সায়ন্তনের দাবি, উঠছে না। তাঁর কথায়, ‘‘কারও দিকে আঙুল ওঠার প্রশ্নই নেই। কোনও একজনের হাত ধরে দলবদল হচ্ছে, এমন তো নয়। এ রাজ্যে এখন সামগ্রিক ভাবেই বিজেপিতে যোগদানের ঢল বেড়েছে। তৃণমূল সেটা বলপ্রয়োগ করে ঠেকানোর চেষ্টা করছে। পারবে না।’’