প্রতীকী ছবি।
স্কুল নেই, সহপাঠীদের সঙ্গে দেখা নেই, খেলাধুলো নেই, হইহল্লা নেই, টিফিন খাওয়া নেই, বেড়াতে যাওয়া নেই। করোনা-কালে তছনছ হয়ে গিয়েছে স্কুলপড়ুয়াদের শৈশব। পড়াশোনার গুরুত্ব কমছে তাদের কাছে। বাড়ছে অস্বাভাবিক আচরণও। ছবিটা শিউরে ওঠার মতোই।
মাধ্যমিকের মার্কশিট নিতে পরীক্ষার্থীদের এ বারের মতো উদাসীনতা আগে দেখেননি রাজ্যের বহু স্কুলের শিক্ষকেরা। অন্য বছর ফল প্রকাশের দিনেই মার্কশিট নেওয়ার জন্য সকলে হামলে পড়ত। আর এ বার? কেউ কেউ অন্যত্র কাজে চলে গিয়েছে বলে জানতে পেরেছে স্কুল। বাগনান হাইস্কুলের প্রধান শিক্ষক ভাস্কর আদক বলছেন, ‘‘এক সপ্তাহ সময় লেগেছে মার্কশিট বিলি করতে। কিছু ছাত্র আবার মার্কশিট নিয়েই যায়নি। তাদের ভাবসাব, নিয়ে কী হবে!’’
‘মোবাইল গেম’ খেলার জন্য ছেলে নিয়মিত স্নান পর্যন্ত করছে না।— আক্ষেপ মুর্শিদাবাদের এক স্কুলপড়ুয়ার মায়ের।
মুর্শিদাবাদেরই রঘুনাথপুরের এক মায়ের অভিজ্ঞতা অবাক করা। কিছুদিন ধরে সকাল ১০টা বাজলেই পঞ্চম শ্রেণির পড়ুয়া ছেলেকে রোজ স্নান করে মিনিট দশেকের জন্য ছাদে চলে যেতে দেখে সন্দেহ হয়েছিল তাঁর। একদিন লুকিয়ে ছাদে উঠে তিনি দেখেন, ছেলে জোড়হাত করে জাতীয় সঙ্গীত গাইছে।
কেন? ছেলে মাকে জানায়, স্কুলে রোজ এই সময়ে ‘প্রেয়ার’ হতো। স্কুলে যেতে পারছে না বলে এখানে ‘প্রেয়ার’ করছে। আফসোস, পাশে কোনও বন্ধু নেই।
মুর্শিদাবাদের জিনাত রেহেনা ইসলাম নামে এক স্কুলশিক্ষিকা লকডাউনের সময় পড়ুয়াদের মানসিক অবস্থা নিয়ে নানা কাজ করেছেন। জিনাত বলেন, “অদ্ভুত সব পরিবর্তন লক্ষ্য করেছি। আজকাল এমন কিছু মোবাইল গেম আছে যেগুলো কথা বলতে বলতে খেলতে হয়। তীব্র প্রতিদ্বন্দ্বিতামূলক ওই সব গেমে জিততে গিয়ে অনেক কিশোরের মুখ দিয়ে অজান্তেই বেরিয়ে আসছে নানা গালিগালাজ!’’
স্কুলপড়ুয়াদের অস্বাভাবিক আচরণের তালিকাটা আরও দীর্ঘ হতেই পারে। রাজ্যের কোণায় কোণায় তার উদাহরণ তৈরি হচ্ছে রোজই। করোনাকালে সব মিলিয়ে এক ‘নেই রাজ্যে’র বাসিন্দা হয়ে গিয়েছে স্কুলপড়ুয়ারা। গরিব-বড়লোক নির্বিশেষে। সব মিলিয়ে অতিমারিতে এ রাজ্যের অসংখ্য ছাত্রছাত্রীর স্কুলবেলা তছনছ হয়ে যাওয়ায় তাদের আচরণেও অ-স্বাভাবিকতা আসছে বলে দাবি করছেন বহু স্কুলের শিক্ষক এবং মনোরোগ বিশেষজ্ঞেরা। বাড়ছে স্কুলছুটের সংখ্যাও। শিক্ষকদের অনেকেই জানিয়েছেন, স্কুলছুটের সঠিক সংখ্যা এখনই বোঝা যাচ্ছে না। স্কুল খুললে তা স্পষ্ট হবে।
তবে কিছুটা স্পষ্ট হচ্ছে ছাত্রদের নানা মানসিক সমস্যার কথা। মনোরোগ চিকিৎসক অনিরুদ্ধ দেব বলেন, “অনলাইন গেমে আসক্তির সমস্যা প্রচুর পাচ্ছি। অনেক বাচ্চার মা-বাবা জানিয়েছেন, অনলাইনে সন্তান কী ‘সার্চ’ করছে, সেটা দেখতে গিয়ে তাঁরা দেখেছেন, সন্তান ‘অ্যাডাল্ট কনটেন্ট’ দেখছে। ‘মাল্টিপল ভিডিয়ো গেম’ খেলতে গিয়ে বাচ্চাদের মধ্যে নানা আচরণগত পরিবর্তন আসছে।” গ্রাম-শহর সর্বত্রই কমবেশি একই চিত্র।
পড়াশোনা যে দিন বদলাতে পারে, এই বিশ্বাসটাই উঠে যাচ্ছে অনেকের। উত্তর ২৪ পরগনার হাবড়ার নবম শ্রেণির এক মেধাবী ছাত্রকে অবসাদ গ্রাস করেছে। তার মধ্যে উগ্র মানসিকতা তৈরি হয়েছে বলে জানিয়েছেন স্কুলের প্রধান শিক্ষক সত্যজিৎ বিশ্বাস। ইছাপুর হাইস্কুলের প্রধান শিক্ষক অশোক পাল বলেন, ‘‘আগে স্কুলের অনলাইন ক্লাসে ১০০ জনের মধ্যে ৪০-৪৫ জন যোগ দিত। এখন কমে হয়েছে ২৭ জন। বাকিরা হতাশায় আগ্রহ হারিয়ে ফেলেছে।’’
বেশি নম্বর পেয়েও অনেকে আবার ভাবছে, ‘আমরা তো কোভিড ব্যাচ। ভবিষ্যতে কেউ আমাদের কোনও সুযোগ দেবে না।’ বাগনানেরই উচ্চ মাধ্যমিক উত্তীর্ণ এক ছাত্রের কথায়, ‘‘আমি কলেজে পড়ব ঠিকই। তবে একটি বেসরকারি সংস্থায় চাকরিও নিয়েছি। যদি দেখি চাকরি করে কলেজে পড়াশোনা করা যাচ্ছে না, তা হলে চাকরিই বেছে নেব। কলেজে পড়েই বা কী হবে? পড়াশোনাই তো হচ্ছে না! কী ভবিষ্যৎ আছে?’’
শিক্ষাবিদদের একাংশ মনে করছেন, অতিমারিতে সবচেয়ে বেশি ক্ষতি হয়েছে প্রথম প্রজন্মের স্বাক্ষর পড়ুয়াদের।তারা বাড়ি থেকে পড়াশোনার কোনও সাহায্য পেল না। স্কুলও বন্ধ। একটা গোটা প্রজন্মের ছাত্রবেলা ধ্বংস হল। হাওড়ার একটি স্কুলের প্রধান শিক্ষক বলেন, ‘‘মাধ্যমিক পরীক্ষার পরে শুধু যে উচ্চশিক্ষার দরজা খোলে তা নয়, বিভিন্ন বৃত্তিমূলক শিক্ষা নেওয়ার সুযোগও মেলে। সেখানে ভর্তি হতে গেলেও মার্কশিট দরকার। কিন্তু কিছু ছাত্রছাত্রী মার্কশিট না-নেওয়ায় এটা বোঝা যাচ্ছে, বৃত্তিমূলক শিক্ষা নেওয়ার ব্যাপারেও তাদের কোনও আগ্রহ নেই।’’
কেন শিক্ষায় ছাত্রছাত্রীদের অনাগ্রহ বাড়ছে, তা খতিয়ে দেখা দরকার বলে মনে করছেন শিক্ষাবিদরা। কিন্তু করোনার গ্রাস থেকে কবে মুক্তি মিলবে, কবে স্কুল খুলবে, সেই উত্তর অজানা। আর সব কিছু স্বাভাবিক হলেও পরিস্থিতি আবার আগের মতো হবে কিনা, তা নিয়েও সংশয় থেকেই যাচ্ছে। (শেষ)