প্রতীকী ছবি।
অতিমারি দেখিয়ে দিয়েছে, পাঠগত সুযোগ-সুবিধা, বিশেষত বৈদ্যুতিন পরিকাঠামোর দিক থেকে শহরাঞ্চলের তুলনায় বাংলার গ্রাম কতটা পিছিয়ে। আর ন্যাশনাল অ্যাচিভমেন্ট সার্ভে (ন্যাস) জানাচ্ছে, বঙ্গে পঠনপাঠনের ক্ষেত্রে গ্রাম ও শহরের পড়ুয়াদের মধ্যে ফারাক এখনও অনেকটাই। সম্প্রতি প্রকাশিত ন্যাসের এই তথ্যে দেখা যাচ্ছে, জাতীয় গড়ের তুলনায় পশ্চিমবঙ্গের পড়ুয়ারা পড়াশোনার গুণমানে অনেক এগিয়ে ঠিকই। তবে গ্রামীণ এলাকা ও শহরাঞ্চলের সার্বিক ফলাফলে এগিয়ে আছে শহরই।
এই সমীক্ষার জন্য ন্যাসের আওতায় গত নভেম্বরে দেশ জুড়ে পরীক্ষা নেওয়া হয়েছিল। তৃতীয়, পঞ্চম, অষ্টম ও দশম শ্রেণির মোট ৩৪ লক্ষ ১১৫৮ জন পড়ুয়া এই পরীক্ষা দেয়। পরীক্ষার্থীদের মধ্যে ৯৮,৬৯৪ জন এই রাজ্যের। ভাষা, বিজ্ঞান, গণিত, সমাজবিজ্ঞান, পরিবেশ বিষয়ে লিখিত পরীক্ষা হয়। সমীক্ষার ফল বলছে, এই সব বিষয়েই পশ্চিমবঙ্গের গ্রামীণ এলাকার ছাত্রছাত্রীরা শহুরে পড়ুয়াদের তুলনায় পিছিয়ে আছে।
সব থেকে ভাল ফল পঞ্জাবের। ওই রাজ্যে গ্রামীণ পড়ুয়াদের ফল শহরের তুলনায় বেশির ভাগ ক্ষেত্রেই ভাল। তৃতীয় শ্রেণির ভাষা পরীক্ষায় পঞ্জাবের গ্রামাঞ্চলের ছেলেমেয়েদের গড় নম্বর ৩৬০। শহরে ৩৫১। বঙ্গে গ্রামের গড় নম্বর ৩৩৩ আর শহরের ৩৪৬। এই শ্রেণির পরীক্ষায় অঙ্কের ক্ষেত্রেও পঞ্জাবের গ্রাম এগিয়ে (৩৪৫)। শহর পেয়েছে ৩৩৫। বঙ্গে গ্রাম পেয়েছে ৩১২। আর শহর ৩১৭। এই শ্রেণিতে পরিবেশবিদ্যায় এই রাজ্যের গ্রামের প্রাপ্ত নম্বর ৩১২ এবং শহরের ৩১৯। পঞ্জাবের চিত্র উল্টো: গ্রামের নম্বর ৩৩৬, শহরের ৩৩২।
পঞ্চম শ্রেণির ভাষার ক্ষেত্রে বাংলার গ্রামাঞ্চলে প্রাপ্ত নম্বর ৩১২। শহর ৩৩০। পঞ্জাবে এ ক্ষেত্রেও এগিয়ে গ্রাম (৩৪১)। শহর ৩৩৮। পঞ্চমের গণিতের ক্ষেত্রেও পঞ্জাবের গ্রাম এগিয়ে (৩১৯)। শহর ৩১৪। বাংলার গ্রাম পিছিয়েই আছে (২৮৭)। শহর ২৯৩। পরিবেশবিদ্যায় বাংলার গ্রামের পড়ুয়ারা পেয়েছে ২৮৮। শহর পেয়েছে ৩০০। পঞ্জাবের ক্ষেত্রে এখানেও গ্রাম কিছুটা এগিয়ে।
অষ্টম শ্রেণিতে ভাষার দক্ষতায় জাতীয় স্তরে গ্রাম ও শহরের ফারাক অনেকটাই। গ্রাম পেয়েছে ২৯৯। শহর ৩২০। পশ্চিমবঙ্গ জাতীয় স্তরের তুলনায় ফল ভাল করলেও গ্রাম আর শহরের ফারাক অনেক। শহর ৩৪০, গ্রাম ৩০৫। অষ্টম শ্রেণির গণিতের ক্ষেত্রে জাতীয় স্তরের প্রাপ্ত নম্বর গ্রামের ক্ষেত্রে ২৫১। শহর ২৫৬। পঞ্জাবে গ্রামের পড়ুয়ারা (২৯৯) কিছুটা হলেও শহুরে পড়ুয়াদের (২৯৫) থেকে ভাল করেছে। বঙ্গে উল্টো ছবি। গ্রাম ২৫২, শহর ২৭৩।
দেখা যাচ্ছে, পঞ্জাবের পাশাপাশি রাজস্থানও কোনও কোনও ক্ষেত্রে বেশ ভাল করেছে। বিশেষ করে রাজস্থানের গ্রামের পড়ুয়াদের ফল বেশ ভাল। গণিতে গ্রামের পড়ুয়াদের প্রাপ্ত নম্বর ২৯৩। শহর ২৭২। এই শ্রেণিতে বিজ্ঞানে পঞ্জাবের গ্রাম ও শহরের পড়ুয়াদের প্রাপ্ত নম্বর একেবারে সমান (২৮৭)। রাজস্থানে গ্রাম এগিয়ে। সমাজবিজ্ঞানেও পশ্চিমবঙ্গে গ্রাম পিছিয়ে। এগিয়ে পঞ্জাবের গ্রাম। দশম শ্রেণিতে আধুনিক ভারতীয় ভাষায় বাংলার গ্রামাঞ্চলের প্রাপ্ত নম্বর শহরের চেয়ে কম।
রাজ্য সরকারি স্কুল শিক্ষক সমিতির সাধারণ সম্পাদক সৌগত বসুর বক্তব্য, করোনাকালে পঠনপাঠনে শহরের তুলনায় গ্রামে ক্ষতি হয়েছে অনেক বেশি। মাল্টিপল চয়েস কোশ্চেন বা এমসিকিউ পদ্ধতিতে যে-পরীক্ষা হয়েছে, তাতে গ্রামের ছাত্রছাত্রীরা খুব একটা সড়গড় নয়। ‘মক টেস্ট’-এর কিছুটা চেষ্টা হয়েছিল। শিক্ষকের সংখ্যা অপ্রতুল। সৌগতবাবুর বক্তব্য, শিক্ষক-শিক্ষিকাদের সদিচ্ছা থাকলে শহরের সঙ্গে গ্রামের পড়ুয়ারাও আরও ভাল ফল করতে পারত। রাজ্যের পাঠ্যক্রম কমিটির চেয়ারম্যান অভীক মজুমদার মনে করেন, ন্যাসের সমীক্ষা রিপোর্টে বঙ্গের শিক্ষা ক্ষেত্রের বেশ উজ্জ্বল ছবিই ফুটে উঠেছে। গ্রাম ও শহরের পড়ুয়াদের ফারাক প্রসঙ্গে তিনি বলেন, ‘‘তৃতীয়, পঞ্চম ও অষ্টমের ক্ষেত্রে এই ফারাক বেশি নয়। দশম শ্রেণির ক্ষেত্রে ফারাকটা বেশি। আমরা বিষয়টি অবশ্যই গুরুত্ব দিয়ে খতিয়ে দেখব।’’