অরবিন্দনগরের এই জমিতেই রবীন্দ্রভবন হওয়ার কথা ছিল। —নিজস্ব চিত্র
লকডাউন তখনও শুরু হয়নি।
মাস চারেক আগে মেদিনীপুরের রাঙামাটিতে জলপ্রকল্পের জমি মাপজোক করতে গিয়েছিল পুরসভার দল। এলাকায় পৌঁছে হতবাক। জমি তো বেদখল হয়ে গিয়েছে! গোটা চত্বর পাঁচিলে ঘেরা। সামনে ঝোলানো তেরঙা ঝান্ডায় লেখা তৃণমূল শ্রমিক সংগঠনের নাম। হইচই শুরু হওয়ায় ঝান্ডা পরে সরেছে। জবরদখল সরেনি।
শুধু জলপ্রকল্প নয়, সরকারি জমি জবরদখল হওয়ায় মেদিনীপুরে হয়নি প্রস্তাবিত রবীন্দ্র ভবন, মধ্যশিক্ষা পর্ষদের আঞ্চলিক কার্যালয় ভবনও। জমি-চক্রের এমনই দাপট।
শহর জুড়েই অবাধে দখল হচ্ছে খাসজমি। এই প্রবণতা রাঙামাটিতে বেশি। দখল করা জমিতে মাথা তুলছে বাড়ি, দোকান। খাসজমি দখল করে ‘বিক্রি’ও হচ্ছে মোটা টাকায়। কাঠা প্রতি দর সাড়ে তিন থেকে চার লক্ষ টাকা। অনেকে বেআইনি ওই জমিতে বাড়ি বানিয়েও বেচছেন। তখন টাকার অঙ্ক লাখ পঁচিশ ছাড়াচ্ছে!
এ-ও অভিযোগ, অবৈধ ভাবে জমির নথিও বদলে নেওয়া হচ্ছে। সরকারি জমি হয়ে যাচ্ছে ব্যক্তিগত, জলাজমি হচ্ছে বাস্তু। দীর্ঘদিন ধরে অরবিন্দনগরে জমি দখলের বিরুদ্ধে আন্দোলন করে আসছেন স্থানীয় বাসিন্দা কার্তিক ধর। কার্তিক বলেন, ‘‘এখানে প্রায় তিরিশ বিঘা সরকারি জমি রয়েছে। চোখের সামনে একের পর এক জমি দখল হয়ে গেল। পুলিশ, প্রশাসন— কেউ কিচ্ছু করল না।’’ কার্তিকের আরও অভিযোগ, ‘‘এখন তো ওখানে ইট-বালি-রডের ব্যবসা চলছে। অবৈধ ভাবে জমি দখল করে কোটি কোটি টাকার ব্যবসা চলছে। গরু কেনাবেচার হাট বসানোরও চেষ্টা চলছে। মদ-জুয়ার ঠেক বসে। সন্ধ্যার পরে সমাজবিরোধীদের উপদ্রব বাড়ে।’’
বাম-আমলে এই এলাকার জমি দখলে মদত দেওয়ার অভিযোগ উঠেছিল তৎকালীন বাম নেতা সুকুমার ভুঁইয়ার বিরুদ্ধে। সেই সুকুমারের এখন দাবি, ‘‘সেই সময়ে ভূমিহীন কয়েক জন বসেছিলেন। সমর্থন করেছিলাম। পরে যারা জমি দখল করেছে, দখল করা জমিতে ঘরবাড়ি বানিয়েছে, ব্যবসা করছে, তারা খুব অন্যায় করেছে।’’
যেমন, অরবিন্দনগরে খাসজমিতে রবীন্দ্র ভবন হওয়ার কথা ছিল ৬ বছর আগে। এক বিন্দু কাজও এগোয়নি। জমির একাংশ জবরদখল করে মাথা তুলেছে ঝুপড়ি। লোকজন সেখানে থাকছেন, হয়েছে দোকান। অনেকে পুরসভাকে ‘স্লাম ট্যাক্স’ দিয়ে বিদ্যুৎ সংযোগও নিয়েছেন। এক সময় এই জমির মাপজোক করতে গিয়ে জবরদখলকারীদের বাধায় ফিরতে হয়েছিল খাস প্রশাসনের দলকে।
রাঙামাটিতে মধ্যশিক্ষা পর্ষদের আঞ্চলিক কার্যালয় হওয়ার কথা ছিল বছর আটেক আগে। তিন একর সরকারি জমি দেওয়া হয়েছিল। কার্যালয় অবশ্য এখনও ভাড়া বাড়িতে চলছে। আর জমির একাংশে হয়েছে একাধিক ব্যক্তিগত বাড়ি। বাড়ি মালিকেরা পুরসভাকে ‘স্লাম ট্যাক্স’ গুনেছেন। খাসজমি দখলের কারণে মেদিনীপুরে মধ্যশিক্ষা পর্ষদের আঞ্চলিক কার্যালয়ের নিজস্ব ভবন এখনও গড়ে ওঠেনি। পর্ষদের এক কর্মী বলছিলেন, ‘‘ভাড়া বাড়িতে চলা দফতরের ঘিঞ্জি ঘরে কাজ করতে হয়। বর্ষাকালে তো খুবই সমস্যা। ভারী বৃষ্টি হলে ছাদ চুঁইয়ে জল পড়ে।’’
এখন প্রশ্ন, প্রশাসনের নাকের ডগায় এমন চক্র কী ভাবে চলছে? বেআইনি দখলদারির মৌচাকে কেন ঢিল পড়ে না? বিরোধীদের দাবি, জমি দখলে ‘মদত’ রয়েছে শাসক দলের কোনও কোনও নেতার। জেলা তৃণমূলের এক নেতাও বলছেন, ‘‘দলের কিছু লোক এ সবে যুক্ত থাকায় নানা প্রশ্নের মুখে পড়তে হচ্ছে।’’
জেলা তৃণমূলের সাধারণ সম্পাদক, মেদিনীপুর শহর তৃণমূলের কার্যকরী সভাপতি স্নেহাশিস ভৌমিক অবশ্য অভিযোগ উড়িয়ে বলেন, ‘‘এ সব বিরোধীদের অপপ্রচার। এক সময় ওই এলাকার দু’-তিনজন কারবার করেছিল। এখন দলের সঙ্গে তাদের সম্পর্ক নেই।’’ তিনি আরও জুড়ছেন, ‘‘শুরুতে আমরা জানতাম না, ওখানে জমি দখল হয়েছে। যখন জেনেছি, তখনই ব্যবস্থা নেওয়া হয়েছে।’’
কিন্তু জবরদখলকারীরা ‘স্লাম ট্যাক্সে’র আওতায় আসছেন কী ভাবে? সদ্য-প্রাক্তন পুরপ্রধান প্রণব বসুর জবাব, ‘‘বিদ্যুৎ, জলের সংযোগ পেতে ট্যাক্সের কাগজ লাগে। ওখানে বসবাসকারীদের আবেদনের ভিত্তিতে স্লাম ট্যাক্সের আওতাভুক্ত করা হয়েছে। নিয়ম মেনেই সব হয়েছে।’’
খাসজমি বেদখলে দলীয় যোগ খারিজ করে দিচ্ছেন তৃণমূলের জেলা সভাপতি অজিত মাইতি, আইএনটিটিইউসি-র জেলা সভাপতি নির্মল ঘোষেরা। তবে ঝান্ডা এল কোথা থেকে? নির্মল ঘোষের জবাব, ‘‘দলের পতাকা নিয়ে কোনও কর্মী-সমর্থক যদি বেআইনি কাজ করে, তার মানে এই নয় দলের তাতে সমর্থন রয়েছে, বা দলের অনুমতি নিয়ে সেই কাজ হয়েছে।’’ আর মেদিনীপুরের (সদর) মহকুমাশাসক দীননারায়ণ ঘোষ ও পশ্চিম মেদিনীপুরের অতিরিক্ত জেলাশাসক (ভূমি ও ভূমি সংস্কার) তুষার সিংলার আশ্বাস, ‘‘খাসজমি দখলমুক্ত হবে।’’
শহরবাসী কিন্তু সংশয়ে। তাঁদের অভিজ্ঞতা বলে, জমি-চক্রকে রোখে কার সাধ্য? এখানে খোদ প্রশাসনের দলই তাড়া খেয়ে ঘরে ফেরে।