অবৈধ অস্ত্রের মুঙ্গেরি আঁতুড় কলকাতাতেই

ভৌগোলিক দিক থেকে দিল্লিই দূর অস্ত্। কিন্তু বেআইনি অস্ত্রশস্ত্র আনার ঝুঁকি ও ঝক্কির বিচারে মুঙ্গের আরও বহুত দূর। দিল্লির থেকেও। সেই দূরত্ব কমিয়ে দিয়ে আস্ত মুঙ্গেরই উঠে এসেছে কলকাতা এবং আশেপাশে।

Advertisement

সুরবেক বিশ্বাস

কলকাতা শেষ আপডেট: ১৬ জুলাই ২০১৫ ০৪:২৫
Share:

ভৌগোলিক দিক থেকে দিল্লিই দূর অস্ত্। কিন্তু বেআইনি অস্ত্রশস্ত্র আনার ঝুঁকি ও ঝক্কির বিচারে মুঙ্গের আরও বহুত দূর। দিল্লির থেকেও।

Advertisement

সেই দূরত্ব কমিয়ে দিয়ে আস্ত মুঙ্গেরই উঠে এসেছে কলকাতা এবং আশেপাশে। সেখানে মুঙ্গেরের কলাকৌশলেই দেদার আগ্নেয়াস্ত্র বানিয়ে চলেছে মুঙ্গেরিলালেরা। এমনই নিপুণ সেই কাজ যে, অচিরেই সেই সব অস্ত্রশস্ত্রে তকমা সেঁটে দেওয়া যেতে পারে ‘মেড ইন ওয়েস্ট বেঙ্গল বাই এক্সপার্টস ফ্রম মুঙ্গের’!

ঘরের কাছে অস্ত্রের এমন আঁতুড় পেয়ে মুঙ্গেরি অস্ত্র পেতে আর ৫০০ কিলোমিটার দূরের মুঙ্গেরে উজিয়ে যাওয়ার দরকার পড়ছে না দুষ্কৃতীদের। কলকাতা এবং তার উপকণ্ঠেই যে ঝকঝকে অটোম্যাটিক অথচ ইম্প্রোভাইজড বা দেশি পিস্তলের ঢালাও উৎপাদন হচ্ছে, তার হদিস দিয়েছে হরিদেবপুরের কবরডাঙার গুলি-যুদ্ধ।

Advertisement

৮ জুলাই রাতে দুষ্কৃতীরা সেখানে ৩৫ রাউন্ড গুলি চালানোর পরে শহরে মজুত বিপুল অস্ত্রশস্ত্র ও বুলেটের
উৎস সন্ধানে নেমে এই নতুন প্যানডোরার বাক্সের ঠিকানা জানতে পেরেছেন তদন্তকারীরা।

উৎসবে মহানগরকে আলোকিত করতে চন্দননগরের আলোশিল্পীদের আনা হয়ে থাকে। কলকাতার অন্ধকার বাড়াতে আনা হচ্ছে মুঙ্গেরের
অস্ত্র-কারিগরদের।

পুলিশ জেনেছে, মুঙ্গেরের ওস্তাদ কারিগরদের একাংশ হাওড়া, উত্তর ও দক্ষিণ ২৪ পরগনার বিভিন্ন প্রান্তে গড়ে ওঠা আগ্নেয়াস্ত্রের কারখানাগুলিতে এসে নাইন ও ৭.২ এমএম পিস্তল এবং রিভলভার তৈরি করছে। তৈরি হচ্ছে ঢালাও বুলেটও।

পুলিশের বক্তব্য, বিহারের মুঙ্গেরে আগ্নেয়াস্ত্র তৈরিতে সিদ্ধহস্ত ওই কারিগরদের কেউ কেউ এই রাজ্যে পাকাপাকি ভাবে চলে এসেছে বাড়তি টাকার আশায়। মুঙ্গেরে তাদের যা রোজগার ছিল, তার চেয়ে অনেক বেশি টাকায় তাদের এখানে নিয়ে এসেছে দুষ্কৃতী দলের পাণ্ডারা। যেমন করেছিল বেলঘরিয়ার প্রোমোটার বাবু সেন ওরফে তারক ঘোষ।

গত ৭ মে মধ্যমগ্রাম উড়ালপুলের মুখে দু’দল দুষ্কৃতীদের মধ্যে বিরোধের জেরে খুন হয় বাবু সেন। পুলিশি তদন্তে বেরোয়, এক সময় বাবু মুঙ্গের থেকে অস্ত্র কিনে এই রাজ্যে বিক্রি করলেও পরে সে নিজেই মধ্যমগ্রামের বাদুতে আস্ত একটি অস্ত্র কারখানা ফেঁদে বসেছিল। মুঙ্গের থেকে এক কারিগরকে এনে মোটা মজুরি দিয়ে সেখানে রেখেছিল সে। বাবুর কারখানায় তৈরি আগ্নেয়াস্ত্র মোটা টাকায় কিনত অপরাধারী।

আবার মুঙ্গেরের কোনও কোনও অস্ত্র-কারিগর এখানে এসে বছরের একটি নির্দিষ্ট সময়ে তিন-চার মাসের জন্য থাকছে এবং চুক্তিমাফিক নির্দিষ্ট সংখ্যক আগ্নেয়াস্ত্র তৈরি করে, টাকা নিয়ে ফের মুঙ্গেরে চলে যাচ্ছে। লালবাজারের এক গোয়েন্দার কথায়, ‘‘এই শ্রেণির কারিগরেরা পাকাপাকি ভাবে কখনও মুঙ্গের ছাড়তে চায় না। এরা হল পশ্চিমবঙ্গে আসা মুঙ্গেরের ‘মরসুমি ওস্তাদ’।

ফি-বছর নির্দিষ্ট মরসুমে আসছে তারা।’’ তবে ওই অফিসার জানান, কয়েক মাসের জন্য পশ্চিমবঙ্গে এসে ওই কারিগরেরা যে-হারে মজুরি পাচ্ছে, সেটা অবশ্যই মুঙ্গেরে পাওয়া মজুরির থেকে বেশি।

আর মুঙ্গেরের এই দু’ধরনের ওস্তাদদের কাজ কাছ থেকে দেখে ও শিখে এখানকার কয়েক জন কারিগর অটোম্যাটিক পিস্তল বানানোয় চোস্ত হয়ে উঠেছে বলে গোয়েন্দাদের দাবি। তদন্তকারীদের বক্তব্য, এক সময় এই বঙ্গজ অস্ত্র উৎপাদকেরা ওয়ান-শটার তৈরি করত। কিন্তু মুঙ্গেরি বিশেষজ্ঞদের দেখে তারা ৭.২ এমএম পিস্তল তৈরি করে ফেলছে অনায়াসে।

ভোটের মুখে এই তথ্য পেয়ে চোখ কপালে উঠছে তদন্তকারীদের। কলকাতা পুলিশের এক সহকারী কমিশনারের কথায়, ‘‘এই রাজ্যেই যদি ঢালাও অটোম্যাটিক পিস্তল তৈরি হতে থাকে, অঢেল জোগানের সুবাদে দাম কমবে অর্থনীতির নিয়মেই। দুষ্কৃতীদের হাতে যে এই ধরনের প্রচুর আগ্নেয়াস্ত্র চলে আসছে, এটাও কিন্তু তার অন্যতম কারণ। অল্প দামে, শহরে বসে, ভিন্ রাজ্যের অস্ত্র-কারবারিদের উপরে নির্ভর না-করেই সেগুলো পাওয়া যাচ্ছে।’’

সেই সঙ্গে বিপুল পরিমাণ বুলেটের জোগানও ঘোর দুশ্চিন্তায় ফেলে দিয়েছে পুলিশকে। লালবাজারের এক শীর্ষ কর্তা বলেন, ‘‘কত বেশি বুলেট মজুত থাকলে একটি ঘটনায় কেবল এক দল দুষ্কৃতীই ৩৫ রাউন্ড গুলি চালিয়ে দিতে পারে, সেটাই
ভাবাচ্ছে আমাদের!’’

ওই অফিসারের বক্তব্য, বছর তিন-চার আগেও হাতে ভাল মানের আগ্নেয়াস্ত্র নিয়ে গুলির অভাবে ভুগেছে দুষ্কৃতীরা। বুলেট জোগাড় করতে তাদের খরচ ও মেহনত দু’‌টোই করতে হয়েছে এবং সেই জন্য তারা বুলেট খরচ করেছে খুব হিসেব করে। কিন্তু এখন পরিস্থিতি ঠিক উল্টো।

পরিস্থিতি পাল্টাল কী ভাবে?

গোয়েন্দারা মনে করছেন, ফায়ারিং রেঞ্জগুলো থেকে বুলেটের খোল জোগাড় করে দেদার গুলি তৈরি হচ্ছে। তদন্তকারীদের দাবি, ফায়ারিং রেঞ্জে পড়ে থাকা গুলির ফাঁকা খোল নিয়ম অনুযায়ী গলিয়ে নষ্ট করে ফেলার কথা। কিন্তু চোরাপথে সেই সব বুলেটের খোল বেরিয়ে যাচ্ছে এবং মোটা দামে তা বিক্রি করা হচ্ছে অস্ত্র ও গুলির উৎপাদকদের কাছে।

গত অক্টোবরে বর্ধমানের খাগড়াগড়ে বিস্ফোরণের সূত্রে জানা যায়, জামাতুল মুজাহিদিন বাংলাদেশ (জেএমবি)-এর মারণাস্ত্র তৈরির কারখানা তথা গবেষণাগারে এ ভাবেই গুলি তৈরি করত জঙ্গিরা।

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
আরও পড়ুন
Advertisement