বহরমপুরেই থাকতে চেয়েছিলাম আমি। চেয়েছিলাম, সাইকেলেই কেটে যাক বেশির ভাগ সময়। ছোটবেলা— যেটা বাঁ দিকের বুকপকেটে নিয়ে প্রত্যেকে সারাজীবন চলাফেরা করে, সেটা আমি কাটিয়েছি বহরমপুর শহরে। পাড়ার নাম লোয়ার কাদাই। আমাদের বাড়িটা ছিল অদ্ভুত। ‘বাড়ি’ বললে অবশ্য বাবা আপত্তি করতেন খুব। বাবা বলতেন ‘বাসা’ (ভাড়া থাকতাম, তাই)।
ভাল বাসাই ছিল। দু’দিকে দু’টো ঘর, মাঝখানে একফালি উঠোন। পাশ দিয়ে বহু পুরনো স্পাইরাল লোহার সিঁড়ি (বাবার কথা অনুযায়ী, কোনও এক জমিদারবাড়ি থেকে তুলে এনে এ বাড়িতে সেট করে দেওয়া হয়েছিল)। সিঁড়িটাকে জড়িয়ে সংসার পেতেছিল একটা বিশাল জবা গাছ, মায়ের হাতে তৈরি। সিঁড়ি পেরোলেই একরত্তি ছাদ, আর শীতকালে ঘুড়ি।
ছিল অ্যাসবেস্টসের চালওয়ালা একটা বাথরুম। আর আমার ঘরের জানলা, ওই জবাগাছ জড়ানো সিঁড়ির গায়ে। বৃষ্টির দুপুরে ওই জানলার ধারে বসে শার্লক হোমস পড়তে কী যে লাগত! বাথরুমের দেওয়াল শ্যাওলা ধরা। জল পড়লে, শুকিয়ে গেলে অদ্ভুত সব অবয়ব।
পাড়ার দু’দিকে দু’টো সিনেমা হল ছিল— কল্পনা আর সূর্য। কল্পনা আর নেই। শুনছি, মাল্টিপ্লেক্স হবে। পাড়ায় আমাদের একটা টিম ছিল— পার্থদা, রতন, পাপাই, আমি, বাবিন, হাটি, বিষ্ণু...। আমাদের একটা সাইকেলের রুট ছিল— লোয়ার কাদাই নিমতলা থেকে আমাদের পাড়া ঘুরে সতীমা, জলের ট্যাঙ্ক, চার্চের মোড় পেরিয়ে বিবেকানন্দ ক্লাব, স্কোয়্যার ফিল্ড, বহরমপুর জেল, মোহন হাউসের মোড় দিয়ে গোরাবাজার, নিমতলা, জজ কোর্টের মোড় হয়ে ওয়াইএমএ মাঠের পাশ দিয়ে গার্লস কলেজ এবং লালদিঘি বাঁ হাতে রেখে রানিবাগান, গাড়োয়ানপাড়া হয়ে নিমতলা আড্ডাখানা। ওই নিমগাছের নীচেই আমরা আড্ডা মারতাম।
আমাদের ক্লাবের নাম ‘আমরা সবাই’। প্রতি বছর চাঁদা তুলে সরস্বতী পুজো করতাম। রতন বানাত ঠাকুর। পাড়ায় প্রাইমারি স্কুল বলতে ভগিনী নিবেদিতা শিশু শিক্ষা নিকেতন। খুব সম্ভবত আমরাই প্রথম ব্যাচ। আমি আর পাপাভাই (আমার মামাতো ভাই) এক সঙ্গে ভর্তি হয়েছিলাম। প্রথম দিন দু’জনেই কান্নাকাটি করে খানিক বাদে বাড়ি ফিরে এসেছিলাম। ক্লাস ফাইভে ভর্তি হলাম জে এন অ্যাকাডেমিতে। অরুণ বন্দ্যোপাধ্যায় ছিলেন হেড মাস্টারমশাই। খুবই ভয় পেতাম, শ্রদ্ধাও করতাম। অসাধারণ হাতের লেখা ছিল। ইংরেজি আর ইতিহাস পড়াতেন।
কিন্তু স্কুল ব্যাপারটা কখনওই খুব পছন্দের ছিল না আমার। সব সময়ে ভাবতাম, কখন ছুটি হবে। ভোর থেকে সন্ধে— আমার গন্তব্য স্কোয়্যার ফিল্ড। খেলতে, আড্ডা মারতে, মনখারাপ হলে। প্রচুর ক্রিকেট ম্যাচ খেলতাম। আমাদের ক্রিকেট টিমের নাম ছিল সিটি ক্লাব। বহরমপুর গেলে এখনও দুপুর-দুপুর ওই মাঠে গিয়ে বসতেই হয় আমায়।
সত্যি বলতে, বহরমপুরে থাকতে শহরের কোনও সিনেমা বা নাটকের ক্লাব বা সংগঠনের সঙ্গে আমার যোগাযোগ হয়নি। এখনও নেই। ছোটবেলায় কখও ভাবিনি যে সিনেমা তৈরি করব। কখনও ভাবতাম, শ্যেন ওয়ার্ন হব, কখনও মারাদোনা। খেলা নিয়ে চূড়ান্ত উত্তেজনা ছিল।
মাধ্যমিকের পর যখন আমি মণীন্দ্র বিদ্যাপীঠে পড়ি, স্কুল যাওয়ার নাম করে আমি আর আমার এক তুতো ভাই অনিন্দ্য চলে যেতাম লালবাগ নবাব প্যালেসে। কামানের উপরে বসে বিড়ি টানতাম। গঙ্গার ধারে ঘুরে বেড়াতাম। বহরমপুরে গঙ্গার ধার ব্যাপারটাই তো অন্য রকম। বিশেষ করে কে এন কলেজ লাগোয়া চায়ের দোকানগুলোর ধার ঘেঁষে।
ওখানে থাকতে কিন্তু আমার প্রেম হয়নি। একটি মেয়েকে নিয়ে আমায় উত্ত্যক্ত করা হত। আমাদের কখনও কোনও কথাই হয়নি। অথচ মেয়েটির নাম নিলেই আমার বিশেষ একটা অনুভূতি হত। মেয়েটিরও হয়তো হত, অথবা হতো না। মেয়েদেরও একটা দল ছিল। ওরাও ব্যাপারটা জানত।
তার পর এক দিন... বাবা আমাকে কলকাতায় পাঠিয়ে দিলেন। তার পরে অন্তত তিন-চারটে বছর খুব কষ্ট পেয়েছি। শেয়ালদায় আমার কলেজ ছিল। সারাক্ষণ মনে হত শেয়ালদায় লালগোলা প্যাসেঞ্জার দাঁড়িয়ে আছে। উঠে বাড়ি চলে যাই। অথবা চলে যাই তেহট্টে।
বহরমপুরে আমাদের বাড়ির উল্টো দিকেই ছিল মামার বাড়ি। দাদু দিদা মামার সঙ্গেই বেড়ে উঠেছি। নদিয়ার তেহট্টে আমার বাপের বাড়ি। সেখানে মাসে-দু’মাসে যেতাম। আর ফিরতে চাইতাম না। দাদু, ঠাকুমা, কাকু, পিসি, গ্রামের রাস্তা-নদী সব অদ্ভুত মায়ায় জড়িয়ে নিত। দু’দিনের জন্য গিয়ে অন্তত সাত দিন লাগত ফিরতে। মাঝে-মাঝেই ইচ্ছে করে, তেহট্ট অথবা বহরমপুরে নদীর ধারে ছোট্ট একটা ঘর করে থেকে যাই।