আনন্দবাজার পত্রিকার শতবার্ষিকী অনুষ্ঠানে মোহন সিংহ খাঙ্গুরা ও সমদীপ্তা মুখোপাধ্যায়। ছবি: সুমন বল্লভ
‘সে যে প্রাণ পেয়েছে পান করে যুগ-যুগান্তরের স্তন্য’— লিখেছিলেন রবীন্দ্রনাথ। আনন্দবাজার পত্রিকার শতবর্ষের পথ চলার স্মারক অনুষ্ঠানের আয়োজনে সেই গুরুবাণীই ছত্রে ছত্রে ধ্বনিত হল সঙ্গীতের মূর্ছনায়। দেশকালের গণ্ডি ছাড়িয়ে বিশ্বসুরের সম্মিলিত অমিয়পাত্রটি তুলে ধরা হল সীমিত পরিসরে। সেখানে সুদূর অতীতের বিস্ময়-আবিষ্কার রাগ-রাগিণীর সম্পাদন যেমন ঘটল, যেমন মূর্ত হল উপনিষদের সুপ্রাচীন আর্ষ, তেমনই বহু যুগের ওপার হতে ধরা দিলেন পাশ্চাত্যের ধ্রুপদী সঙ্গীতের চিরন্তন চিরবিস্ময়। একটি প্রতিষ্ঠানের একশো বছরের যাপন যে ঐতিহ্যের সুষমাতে লালিত, তার সুগন্ধ ছড়িয়ে গেল বিশ্ব বাংলা কনভেনশন সেন্টারে।
সকালে অনুষ্ঠান। শুরু সরোদে, আনন্দভৈরবে। সূচনা-মুহূর্তের আবেশ ধরার জন্যই সকালের সঙ্কর রাগ। শিল্পী আমান আলি খান। শতবর্ষ উদ্যাপনের সুর বেঁধে দিল এই আয়োজনের জন্য গ্রন্থিত শিল্পীর অনবদ্য বাদনের মূর্ছনা। সঙ্গে ছিল দৃশ্যশ্রাব্য উপস্থাপনায় আনন্দবাজার পত্রিকার পেরিয়ে আসা সময়ের চুম্বকছবি। আমান আলি খানের পরম্পরাঋদ্ধ, মিড়মূর্ছিত, সুঠাম বাদনে মুহূর্তে যা জেগে উঠল, তাকে ‘মধুর’ শব্দ ছাড়া বিশেষিত করা অসম্ভব। পরিমিত আকারের বাদনে যেন সবটুকু উজাড় করে দিলেন শিল্পী। কী অনুপম ভাবে শাস্ত্রীয় পরিসরে নন্দিত কৃৎকৌশলে শিল্পী জুড়ে দিয়েছেন চিরায়ত লোকগানের আখরবিন্যাসও।
অনুষ্ঠানের নানা পর্ব। তারই মধ্যেমাঝে সুরের আলিম্পন। পরের শিল্পী সমদীপ্তা মুখোপাধ্যায়। নবীন শিল্পী ধরলেন বহু-বহু যুগান্তরের সুপ্রাচীন আখর। দেবভাষায়। ঐতরেয় উপনিষদ। শান্তিমন্ত্র। ‘ওঁ বাঙ্মে মনসি প্রতিষ্ঠিতা/মনো মে বাচি প্রতিষ্ঠিতম্, আবিরাবীর্ম এধি...ওঁ শান্তিঃ শান্তিঃ শান্তিঃ’— আমার কথা হৃদয়ে প্রতিষ্ঠা পাক। আমার হৃদয় কথায় প্রতিষ্ঠিত হোক। হে ব্রহ্ম, হে স্বয়ম্প্রকাশ, আপনি প্রতিষ্ঠিত হোন আমাতে...। শিল্পী দুরন্ত মুনশিয়ানায় স্তোত্রটি প্রথমে ভৈরবে ধরে পরে এলেন জৌনপুরিতে। লাবণ্যময় কণ্ঠের অনুরণন সুস্থির মাত্রায় স্নিগ্ধ করল শ্রোতার হৃদয়।
প্রবীণ শিল্পী মোহন সিংহ খাঙ্গুরা ধরলেন মহর্ষি দেবেন্দ্রনাথ ঠাকুরের কম্পোজিশন ‘পরিপূর্ণম্ আনন্দম্’। যে গান একদিন কাশীপুর উদ্যানবাটীতে শ্রীরামকৃষ্ণকে শুনিয়েছিলেন নরেন্দ্রনাথ দত্ত। যে গানের পঙ্ক্তি উল্লেখ করে রবীন্দ্রনাথ একাধিক জায়গায় ‘পরিপূর্ণমানন্দম্’ শব্দবন্ধ ব্যবহার করে গিয়েছেন। দেশ রাগে নিবদ্ধ পরিপূর্ণ আনন্দেরই আস্বাদন— ‘অঙ্গ বিহীনং স্মর জগন্নিধানম্’। শ্রুতি পবিত্র করা এই গানে নির্মেদ আয়োজনের গায়ে পরমানন্দ সুন্দর তাঁর স্নিগ্ধ হাতটি রাখলেন।
পরবর্তী সঙ্গীত-পর্বে কিংবদন্তি মোৎজার্ট। তাঁর ৪০ নম্বর সিম্ফনি, গ্রেট জি-মাইনর ভারতীয় মার্গগানের নোটেশনে গাইলেন সমদীপ্তা মুখোপাধ্যায়। ধ্রুপদী এই সিম্ফনির চারটি ‘মুভমেন্ট’ বা পর্বের প্রথমটি, মল্টো অ্যালেগ্রোর কিছু অংশ গাইলেন শিল্পী। ১৭৮৮ সালে তৈরি সিম্ফনি। অপেক্ষাকৃত দ্রুতগতির এই অংশের পেশকারিটি ছিল তুলনাহীন এবং খানিক অকল্পনীয়ও। কারণ, সহজ নয় উপমহাদেশের স্বরলেখের চলনে ওই কঠিন সোনাটা হুবহু পেশ করা।
আয়োজনের পরের উপস্থাপনা রবীন্দ্রনাথের গান, মোহন সিংহ খাঙ্গুরার কণ্ঠে— ঝাঁপতালে খট রাগাশ্রিত ‘সদা থাকো আনন্দে’। ১৮৯৯ সালের রচনা। ‘পূজা’ পর্বের এ-গান শেষ হয় ‘সবারে ক্ষমা করি থাকো আনন্দে/ চির-অমৃতনির্ঝরে শান্তিরসপানে’। শিল্পীর দানাময় কণ্ঠে সকাল-গন্ধী আশাবরী ঠাটের এ সুর অমিয় লাবণ্যে উদ্ভাস পেল। তার কথায় উপচে পড়া আনন্দের আলো প্রতিফলিত হল। পাখোয়াজে বিপ্লব মণ্ডলের সঙ্গত ছিল মাপা এবং সুন্দর।
অনুষ্ঠানের সঙ্গীত-আবেশের আর একটি বড় চমক ছিল একেবারে শেষে। তিমিরবরণ ভট্টাচার্যের তৈরি দুর্গা রাগে বঙ্কিমচন্দ্রের ‘বন্দে মাতরম্’-এর অর্কেস্ট্রেশন। যা ১৯৩৯ সালে রেকর্ড করা হয়েছিল আনন্দবাজার পত্রিকার পূর্বতন সম্পাদক অশোককুমার সরকারের উদ্যোগে। মাত্র ৪৫ সেকেন্ডের উপস্থাপনাটি সিম্ফনি অর্কেস্ট্রার ঐশ্বর্যে ফেলে আসা সেই সময়ের উদ্দীপনারই আলোকপ্রভ আয়না।
গোটা উপস্থাপনায় দিনমানের সময় বিবেচনা করেই গান-সুরের নির্বাচন। শিল্পীদের উপস্থাপনার মূল জাদুটি ছিল স্নিগ্ধতার। এবং মূল সুরটি ধরা ছিল পরিপূর্ণ আনন্দের বার্তায়, পরিপূর্ণ আনন্দের আস্বাদনে, পরিপূর্ণ আনন্দের আশ্বাসে।