প্রত্যয়ী: নিজের হাসপাতালের সামনে সুবাসিনী মিস্ত্রি। ছবি: অরুণ লোধ
কলকাতার কপোর্রেট হাসপাতালগুলির কর্তাদের দিকে প্রশ্নটা ছুড়ে দিলেন ৭৩ বছরের বৃদ্ধা।
তাঁর প্রশ্ন, ‘‘আমি পারলে আপনারা পারবেন না কেন?’’
স্রেফ কথার কথা নয়, কী ভাবে কম খরচে মানুষের কাছে চিকিৎসা পরিষেবা পৌঁছে দেওয়া যায় তা পরখ করতে রাজ্যের কর্পোরেট হাসপাতালগুলির কর্তাদের নিজের হাসপাতালে আমন্ত্রণ জানিয়েছেন বৃদ্ধা। তাঁর দাবি, ‘‘ইচ্ছে থাকলে উপায় যে হয় তা আমি ওঁদের দেখাতে চাই। মানুষের পাশে দাঁড়ালে আশীর্বাদ পাবেন।’’
ঠাকুরপুকুর বাজার লাগোয়া হাসপুকুরে হাসপাতাল বুড়িমার হাসপাতালে না-গেলে বোঝাই যেত না কীসের জোরে তিনি এই ভাবে তিনি চ্যালেঞ্জ জানাতে পারেন কর্পোরেট হাসপাতালকে।
১৯ কাঠা জমির উপর ৪৫ শয্যার হাসপাতাল। ২০ জন ডাক্তার (এর মধ্যে স্থায়ী-বেতনভুক ৪ জন, বাকিরা টাকা না-নিয়ে চিকিৎসা করেন), ৩২ জন নার্স। গরিব রোগীদের এক টাকাও লাগে না সেখানে চিকিৎসার জন্য। বিনা পয়সায় তাঁরা পান ওষুধ। ১০ শয্যার আইসিসিইউ। নিখরচায় ভেন্টিলেশন। আউটডোর ছাড়াও মেডিসিন, সার্জারি, গাইনি, আই, ইএনটি, ইউরোলজি, পেডিয়াট্রিক, ইউরোলজি-সহ একাধিক বিভাগ চলে এখানে। অস্ত্রোপচার হয়। হয় প্রায় সব রকম পরীক্ষা।
নাম ‘হিউম্যানিটি হসপিটাল’। তবে লোকমুখে পরিচিতি ‘বুড়িমার হাসপাতাল’ নামেই।
বছর কুড়ি আগেও সুবাসিনীকে মিস্ত্রিকে এলাকার মানুষ চিনতেন ‘সব্জি মাসি’ বলে। তিনিই এখন হাসপুকুরের ‘হাসপাতাল দিদিমা’! কী ভাবে সম্ভব হল এই পরিবর্তন? আনাজ বিক্রেতা এক মহিলা কী ভাবে তৈরি করলেন একটা হাসপাতাল? এত টাকাই বা পেলেন কোথা থেকে?
পাড়ার বয়স্করা শোনাচ্ছিলেন সেই কাহিনী। সুবাসিনী মিস্ত্রি তাঁর দিনমজুর স্বামী সাধনের চিকিৎসা করাতে পারেননি। সরকারি হাসপাতালে শয্যা মেলেনি, আর বেসরকারি হাসপাতালে ভর্তি করানোর সামর্থ্য ছিল না। কার্যত বিনা চিকিৎসায় সাধন মিস্ত্রি যখন মারা যান তখন বাড়িতে এক টাকারও সঞ্চয় নেই। চারটি ছোট ছেলেমেয়ে। সুবাসিনীর অক্ষর পরিচিতি পর্যন্ত ছিল না।
এর পরের কাহিনী সিনেমার গল্পের মতো।
প্রতিবেশী এক প্রবীণ অধ্যাপক বললেন, ‘‘লোকের বাড়ি কাজ করা দিয়ে ওঁর যুদ্ধ শুরু। লোকের এঁটো খেতেন। বাচ্চাদের নিয়ে ধাপার মাঠে ময়লা ঘেঁটে কয়লা তুলে বিক্রি করতেন। সবশেষে চৌবাগা থেকে ভোর তিনটেয় ঠেলাগাড়িতে আনাজ তুলে কোলের বাচ্চাটাকে তার উপর বসিয়ে ঠেলে চার নম্বর ব্রিজের তলার বাজারে নিয়ে গিয়ে বিক্রি করা শুরু করেন।’’ বাকি ছেলেমেয়েদের দিয়েছিলেন অনাথ আশ্রমে।
সরশুনার বাসিন্দা অবসরপ্রাপ্ত সরকারি চিকিৎসক রঘুপতি চট্টোপাধ্যায় বলছিলেন, ‘‘প্রথম যে দিন পাড়ার লোকেদের ডেকে হাসপাতাল করবেন বলে উনি জানালেন, আমরা কেউ বিশ্বাস করিনি। যে দিন দেখলাম ধান জমিতে কোমর জল ঠেলে মাথায় করে মাটি নিয়ে ফেলছেন তখন আমরা ভাবতে শুরু করলাম কিছু একটা করবেন উনি।’’ তাঁর কথায়, ‘‘তখনই আশপাশের মানুষ, গ্রাম প্রধান সবাই এককাট্টা হয়ে তৈরি করলেন ট্রাস্ট। স্বেচ্ছাসেবী বাহিনী তৈরি হল। সবাই টাকা দিল। এত কাদা ছিল যে, বাঁশের রণপা পরে হাসপাতাল তৈরির কাজ তদারকি করতে যেতাম আমরা। সেটা নব্বই দশকের গোড়ার দিকে কথা। প্রথমে তৈরি হল আটচালা, পরে এই বাড়ি,’’— বলছিলেন প্রবীণ চিকিৎসক।
এখন আধময়লা শাড়ির ঘোমটাটা মাথায় টেনে বুড়িমা ঘুরে বেড়ান হাসপাতালের প্রতিটি ঘরে, রোগীদের কাছে। ফোকলা দাঁতে হেসে বলেন, ‘‘সবাই বলেছিল, মাথা খারাপ হয়ে গিয়েছে। কিন্তু যে কাছের লোককে হারিয়েছে সে জ্বালাটা জানে। জেদ ছিল, যেন আমার স্বামীর মতো কাউকে মরতে না-হয়। ভাল কাজে ঠিক লোক আর টাকা জুটে যায়।’’
নিজের হাসপাতালটি কর্পোরেট হাসপাতালের কর্তাদের ঘুরিয়ে দেখাতে চান তিনি। যদি ওঁদের মন বদলায়!