ভোগান্তি ভুলে প্রতিবাদের উৎসবে হাওড়া

নতুন নাগরিকত্ব আইনের বিরোধিতায় বুধবার দুপুরে হাওড়া থেকে মিছিল করলেন মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়।

Advertisement

দেবাশিস দাশ ও শান্তনু ঘোষ

কলকাতা শেষ আপডেট: ১৯ ডিসেম্বর ২০১৯ ০৩:৫৫
Share:

জোটবদ্ধ: নতুন নাগরিকত্ব আইনের প্রতিবাদে হাওড়া থেকে মিছিল এগোচ্ছে ধর্মতলার দিকে। বুধবার দুপুরে। ছবি: দীপঙ্কর মজুমদার

মিছিলের জটে স্তব্ধ হয়ে যাওয়া হাওড়ায় এ যেন ‘বিরোধিতার উৎসব’!

Advertisement

নতুন নাগরিকত্ব আইনের বিরোধিতায় বুধবার দুপুরে হাওড়া থেকে মিছিল করলেন মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। সেই মিছিল থেকে ভেসে এল ওই আইন নিয়ে গাওয়া বাউলদের গান। দেখা গেল সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতির প্রতীক বহুরূপীদেরও। কেউ কেউ আবার নতুন তৈরি হয়ে আসা ৩১০ ফুটের দলীয় পতাকা ধরে হাঁটলেন মিছিলে।

তবে ওই মিছিলের জেরেই এ দিন কয়েক ঘণ্টা ধরে অবরুদ্ধ হয়ে রইল হাওড়া। বঙ্কিম সেতুর নীচ থেকে ডোরিনা ক্রসিং পর্যন্ত আসে মিছিল। যার জন্য এ দিন সকাল থেকেই বদলে গিয়েছিল হাওড়া শহরের প্রাণকেন্দ্র ময়দান চত্বরের পরিবেশ। দুপুর একটায় মুখ্যমন্ত্রীর আসার কথা থাকলেও বেলা ১১টা থেকে বঙ্কিম সেতুতে বাস ও বড় যানবাহন চলাচল বন্ধ করে দেওয়া হয়েছিল। বঙ্কিম সেতুর নীচের রাস্তা মহাত্মা গাঁধী রোড ও ঋষি বঙ্কিমচন্দ্র রোডও এ দিন সকাল থেকে আটকে দেওয়া হয়। বন্ধ করে দেওয়া হয়েছিল হাওড়া হাসপাতালের পশ্চিম দিকের গেটও। একই ভাবে আদালতে ঢোকার পশ্চিম দিকের পথও আটকে দিয়েছিল পুলিশ। আর পুরসভার সব গেটই পুলিশি ঘেরাটোপে আটকে দেওয়া হয়।

Advertisement

এ দিন বঙ্কিম সেতুর নীচে বাঁধা মঞ্চে মুখ্যমন্ত্রীকে দেখতে ভিড় জমিয়েছিলেন আইনজীবীরাও। মিছিলেও পা মিলিয়েছেন অনেকে। কেউ মুখ্যমন্ত্রীকে দেখে ফিরে গিয়েছেন সেরেস্তায়। হাওড়া ক্রিমিনাল বার লাইব্রেরির সভাপতি সমীর বসুরায়চৌধুরী বলেন, ‘‘প্রথমার্ধে কাজ বন্ধ রাখার জন্য আমরা আদালতে আবেদন জানিয়েছিলাম। তবে তার জন্য আদালতের কাজে কোনও সমস্যা হয়নি।’’ আদালতে আসা মানুষজনের অবশ্য অভিযোগ, প্রথমার্ধে অনেক মামলা না ওঠায় তাঁদের সমস্যায় পড়তে হয়।

মুখ্যমন্ত্রীর নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে পুলিশ হাওড়ার প্রাণকেন্দ্র ঘিরে ফেলায় বিভিন্ন জায়গায় আটকে পড়েন সাধারণ মানুষ। তৈরি হয় যানজট। দুপুর পৌনে ২টো নাগাদ মিছিল শুরু হতে সেই জট আরও বাড়ে। যার রেশ চলে প্রায় তিনটে পর্যন্ত। কিন্তু সেই ভোগান্তি সাগ্রহেই মেনে নিয়েছেন শালিমারের বাসিন্দা ঊষা দেবী। আসানসোল যাওয়ার ট্রেন ধরতে হাওড়া স্টেশনে আসছিলেন ট্যাক্সি চেপে। মাঝপথে যানজটে আটকে যান। তখন মেয়েকে নিয়ে ট্যাক্সি থেকে নেমে ট্রলি ব্যাগ টেনে এগোচ্ছিলেন স্টেশনের দিকে। তিনি বললেন, ‘‘একটু হাঁটলে আর কষ্ট কীসের! আরও অনেক বড় কষ্ট থেকে তো রক্ষা পেতে হবে।’’

দেশ ভাগের কষ্ট সহ্য করা কঠিন বলেই মনে করেন বেলিলিয়াস রোডের অশীতিপর বৃদ্ধা আনোয়ারা বেগম। অশক্ত শরীর নিয়ে ঠিক মতো হাঁটতে না পারলেও প্রতিবেশী যুবক মইদুল আলমের হাত ধরে এগিয়ে যাচ্ছিলেন হাওড়া সেতুর দিকে। তারই মাঝে একটু থমকে বৃদ্ধা বললেন, ‘‘নতুন নাগরিকত্ব আইনটা যে কী, জানি না বাপু। শুধু জানি, দিদি ঠিক করছেন, এ দেশ ভাগ করা যাবে না।’’ কিন্তু বিরোধিতার নামে অশান্তি সমর্থন করেন না বৃদ্ধা। তাঁর সঙ্গে সহমত বিহারের মজফ্ফরপুরের পবন দাসও। হাওড়া মাছ বাজারের শ্রমিক পবন এ দিন বঙ্কিম সেতুর উপরে দাঁড়িয়ে দেখছিলেন মিছিল। তাঁর কথায়, ‘‘আমাদের মাছ বাজার তো মিনি ভারতবর্ষ। এখানে সব রাজ্যের লোক আছেন। আমরা সকলে ভাই ভাই। এত বছরের এই সম্পর্কে বিভেদ ধরানোর কোনও দরকার নেই।’’

এ দিন অন্যদের সঙ্গে মাছ বাজারের ছাদে দাঁড়িয়ে মুখ্যমন্ত্রীর মিছিল দেখছিলেন বিহারের বৈশালীর বাসিন্দা, পেশায় শ্রমিক মহম্মদ মোসলেম। তাঁর কথায়, ‘‘বিভেদ রুখতে এমন শান্তিপূর্ণ মিছিল হোক। রাস্তা অবরোধ হলেও বাস পোড়ানো বা ভাঙচুর ঠিক নয়। প্রতিবাদ হোক শান্তিতে।’’ মাথায় ফোমের ঘাসফুলের তৈরি বড় টুপি পরে মিছিলে হাঁটছিলেন সুভাষগ্রামের রাখাল দাস। মুখ্যমন্ত্রীর কোনও সভা বা মিছিল হলেই সেখানে ঘাসফুল টুপি বিক্রি করেন তিনি। গত দু’দিনের মিছিলে ১০ হাজার টাকার টুপি বেচেছেন। টুপি বিক্রির ফাঁকেই বললেন, ‘‘কিছু কাজ করে তো দু’মুঠো ভাত জোগাড় করছি। দেশটা ভাগ হলে সব শেষ হয়ে যাবে।’’

মিছিলের সামনে থেকে তখন ভেসে আসছে গান—‘বাংলার হিন্দু-মুসলিম-বৌদ্ধ-খ্রিস্টান, ভাগ হবে না’।

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
আরও পড়ুন
Advertisement