সাগর ঘোষ হত্যা-মামলা

সিবিআই চান না আর, হৃদয়ের হৃদয় বদল!

ডিগবাজি বললেও বোধহয় কম বলা হবে, শুক্রবার ফোনে তীব্র শ্লেষের সুরে বললেন বীরভূম জেলা বিজেপি-র এক নেতা। কেন বললেন?

Advertisement

নিজস্ব প্রতিবেদন

শেষ আপডেট: ০৮ অগস্ট ২০১৫ ০৩:২২
Share:

ডিগবাজি বললেও বোধহয় কম বলা হবে, শুক্রবার ফোনে তীব্র শ্লেষের সুরে বললেন বীরভূম জেলা বিজেপি-র এক নেতা।

Advertisement

কেন বললেন?

কারণ, খবরটা তত ক্ষণে দাবানলের মতো ছড়িয়েছে জেলার রাজনৈতিক শিবিরে। পাড়ুইয়ের সাগর ঘোষ হত্যা-মামলায় আর সিবিআই তদন্ত চান না নিহতের ছেলে হৃদয় ঘোষ! এ দিন সুপ্রিম কোর্টে সেই মর্মে আবেদনও জানিয়েছেন তিনি। মোদ্দা কথায়, যে সিবিআই তদন্ত হাতে নিলে বীরভূম জেলা তৃণমূলের দাপুটে সভাপতি অনুব্রত মণ্ডল মোটেও স্বস্তিতে থাকতে পারতেন না, যে সিবিআই তদন্ত চেয়ে এক দিন হৃদয়ই দ্বারস্থ হয়েছিলেন সর্বোচ্চ আদালতের, আজ সেই কেন্দ্রীয় তদন্ত সংস্থাকেই আর চাইছেন না তিনি।

Advertisement

প্রথম দিন থেকেই মুখ্যমন্ত্রী তাঁর পাশে। এমনকী, আদালতে দাঁড়িয়ে তাঁকে ক্লিনচিট দিয়েছেন রাজ্য পুলিশের ডিজি-ও। আর এ বার তো অনুব্রত ওরফে কেষ্ট মণ্ডলকে স্বস্তি দিলেন স্বয়ং অভিযোগকারী।

কতটা স্বস্তি?

জেলা তৃণমূলের একাংশের মতে, বিশাল স্বস্তি। কারণ, সাগরবাবুর খুনের পরে তাঁর পরিবার যে এফআইআর করেছিল, তাতে অভিযুক্তের তালিকায় প্রথম নামটিই ছিল জেলা তৃণমূল সভাপতির। দ্বিতীয় স্থানে ছিলেন, জেলা পরিষদের সভাধিপতি, অনুব্রত-ঘনিষ্ঠ বিকাশ রায়চৌধুরী। নিম্ন আদালতে (সিউড়ি জজ কোর্ট) পাড়ুই-মামলার শুনানি চলছে। সেখানে যে চার্জশিট জমা দিয়েছে রাজ্য সরকারের স্পেশাল ইনভেস্টিগেশন টিম বা সিট, তাতে যে নাম নেই স্বয়ং অনুব্রতরই! অর্থাৎ, সুপ্রিম কোর্ট হৃদয়বাবুর আর্জি মেনে নিলে (আইনজীবীদের একাংশের মতে, সে সম্ভাবনাই প্রবল) সাগর-হত্যায় আর অনুব্রত-বিকাশকে নিয়ে টানাটানি হবে না। বিধানসভা ভোটের আগে যা তাঁদের পক্ষে খুবই স্বস্তির।

সবিস্তার দেখতে ক্লিক করুন।

অনুব্রতর মুখে তাই চওড়া হাসি। অনুব্রত এখন আর মনে রাখতে চান না, ‘ঘরের ছেলে’ হৃদয় ঘোষই এক দিন তাঁর বিরুদ্ধে তোপ দেগে বিজেপি-তে চলে গিয়েছিলেন। তাই যে হৃদয়কে ক’দিন আগেও গালমন্দ করেছেন, সেই তিনিই এ দিন বোলপুরে নিজের পার্টি অফিসে বসে বলে দিলেন, “পরিবারে মতানৈক্য থাকতেই পারে। অতীতে আমরা এক সঙ্গে দল করেছি। হৃদয়রা ঘরের ছেলে, ঘরে ফিরছে!”

সুপ্রিম কোর্টে হৃদয়বাবুর আইনজীবী রাজা চট্টোপাধ্যায় এ দিন বলেন, ‘‘আমার মক্কেল এই মামলা আর চালাতে চাইছেন না। অন্যান্য বিকল্প খতিয়ে দেখতে চান। আর কোনও কারণ আবেদনে বলা হয়নি।’’ পাশাপাশি নিম্ন আদালতে ফের মামলার প্রক্রিয়া শুরু করতে পুরনো স্থগিতাদেশ তুলে নেওয়া হোক বলেও তাঁরা আবেদন করেছেন সুপ্রিম কোর্টে। হৃদয়বাবু এ দিন দিল্লিতেই ছিলেন। তাঁর বক্তব্য, ‘‘মামলা চালানোর ব্যাপারে বহু আশ্বাস আমি অনেকের থেকে পেয়েছিলাম। কিন্তু সেই আশ্বাস কতখানি কার্যকরী, তা নিয়ে আমার ধন্দ তৈরি হয়েছে। মামলা চালানোর মতো আর্থিক সঙ্গতিও নেই। বাড়ির লোক ও আত্মীয়-পরিজনদের সঙ্গে আলোচনা করে এই সিদ্ধান্ত নিলাম।’’

এ বার কি তা হলে তৃণমূলে যোগ দিতে চলেছেন? এক সময় তৃণমূল ছেড়েই বিজেপি-তে আসা হৃদয়বাবু বলেন, ‘‘এখনই কিছু বলব না। পরিস্থিতি বুঝে সিদ্ধান্ত নেব।’’ অনুব্রতর সঙ্গে কি আপনাদের কোনও গোপন সমঝোতা হয়েছে? নিরুত্তর থাকেন সাগরবাবুর ছেলে। মুখে কুলুপ এঁটেছেন নিহত সাগরবাবুর স্ত্রী সরস্বতীদেবী এবং পুত্রবধূ শিবানীও। এ দিন পাড়ুইয়ের বাঁধনবগ্রামে (সাগরবাবুর বাড়ি) গেলে দু’জনের কেউ-ই সংবাদমাধ্যমের মুখোমুখি হতে চাননি। তা হলে রাজ্য সরকারের তৈরি করা স্পেশাল ইনভেস্টিগেশন টিম বা সিট-এর তদন্তেই আপনারা সন্তুষ্ট? অনুব্রতর বিরুদ্ধে কি তা হলে মিথ্যা অভিযোগ করেছিলেন? শাশুড়ি-বৌমার একই জবাব, ‘‘এ নিয়ে আমরা কিছু বলব না।”

২০১৩ সালের পঞ্চায়েত ভোটে পাড়ুইয়ের কসবা পঞ্চায়েতে নির্দল প্রার্থী (‌সে সময়ের অনুব্রত-বিরোধী বিক্ষুব্ধ তৃণমূল) হিসেবে ভোটে দাঁড়িয়েছিলেন হৃদয় ঘোষ। ভোটের আগের রাতে (২১ জুলাই) হৃদয়বাবুর বাড়িতে ঢুকে তাঁর বৃদ্ধ বাবা সাগর ঘোষকে খুন করে দুষ্কৃতীরা। রাজ্য রাজনীতিতে হইচই ফেলে দেওয়া ওই ঘটনায় অনুব্রত, বিকাশ-সহ তৃণমূলের ৪১ জন নেতা-কর্মীর নামে খুনের অভিযোগ দায়ের হয়। সিট-এর তদন্তে অসন্তোষ প্রকাশ করে হাইকোর্টে সিবিআই চেয়ে আবেদন করেন হৃদয়বাবুরা। বিচারপতি হরিশ টন্ডন সিবিআই তদন্তের নির্দেশ দেন। ওই নির্দেশ খারিজ করে দেয় ডিভিশন বেঞ্চ। আর তার পরেই সুপ্রিম কোর্টে যায় সাগরবাবুর পরিবার। নিম্ন আদালতে মামলার শুনানির স্থগিতাদেশ দেয় সুপ্রিম কোর্ট।

মামলার এই অগ্রগতির মধ্যেই বোলপুরে বিজেপি সাংসদ বাবুল সুপ্রিয়র সভায় দলের রাজ্য সভাপতি রাহুল সিংহের উপস্থিতিতে হৃদয়বাবু-সহ পাড়ুইয়ের বেশ কিছু তৃণমূল নেতা-কর্মী বিজেপি-তে যোগ দেন। ফলে প্রশ্ন উঠেছে, দু’বছর ধরে যে পরিবার দাঁতে দাঁত চিপে সুবিচারের আশায় লড়াই চালিয়ে গেল, আজ তারাই হঠাৎ সিবিআই তদন্ত তুলে নেওয়ার আর্জি জানাল কেন?

হৃদয়বাবু নিজে এই সিদ্ধান্তের পিছনে কোনও ‘রাজনৈতিক চাপ নেই’ দাবি করলেও বিরোধীরা তা মানতে নারাজ। প্রদেশ কংগ্রেস সভাপতি অধীর চৌধুরীর দাবি, ‘‘বর্তমান সরকার ভয় ও প্রলোভন দেখিয়ে রাজ্য চালাচ্ছে। না হলে হৃদয় ঘোষের মতো প্রতিবাদী পরিবারের মামলা তুলে নেওয়ার পরস্থিতি হতো না!’’ বামফ্রন্ট চেয়ারম্যান বিমান বসুর বক্তব্য, ‘‘তৃণমূল সরকার এবং দল দু’টোই নীতিহীন। তারা মানুষকে প্রথমে ভয় দেখায়। না হলে টাকা পয়সা দেওয়ার প্রলোভন দেখায়। শেষ পর্যন্ত ‘গান পয়েন্টে’ নিয়ে যায়। অতীতে বহু ক্ষেত্রেই তৃণমূল চাপ দিয়ে মামলা তুলিয়েছে। সম্ভবত এ ক্ষেত্রেও তা-ই হয়েছে।’’ একই সুরে বাবুল সুপ্রিয় বলেন, ‘‘রাজ্য রাজনীতিতে অনেক কাণ্ডকারখানাই হচ্ছে। অনেক কিছুই চাপ দিয়ে করিয়ে নেওয়া হচ্ছে। মানুষ সব বুঝতে পারছেন। বিজেপি গোটা পরিস্থিতির উপরে নজর রাখছে।’’ আর রাহুল সিংহের কটাক্ষ, ‘‘অনেকে আশ্বাস দিলেও কাজের কাজ কিছু হল না বলে বাবাকে যারা খুন করল, তাদের কাছে বিক্রি হয়ে গেলেন! আমি এই প্রথম কাউকে বাবার মৃতদেহ বিক্রি করতে দেখলাম! আর সুপ্রিম কোর্টে ওঁর (হৃদয়ের) যে মামলা চলছিল, তার জন্য বিজেপি কত টাকা খরচ করেছে, তার নথি আমার
কাছে আছে।’’

ঘটনা হল, হৃদয়বাবু-সহ বিক্ষুব্ধ যে-সব তৃণমূল নেতা-কর্মী বিজেপি-তে গিয়েছেন, তাঁদের বিরুদ্ধে খুন-সহ একাধিক মামলা করেছে তৃণমূল। পাড়ুইয়ের এক বিজেপি নেতার কথায়, ‘‘ওই সব মামলায় জড়িয়ে হৃদয়দের উপরে দিনের পর দিন চাপ বাড়াচ্ছিল তৃণমূল। আমাদের কাছে খবর আছে ওই সব মামলা থেকে মুক্তি পাওয়ার শর্তেই ওদের সঙ্গে হৃদয়দের আঁতাত হয়েছে।’’ তাঁর আরও দাবি, জেলা পুলিশের এক শীর্ষ কর্তার মধ্যস্থতাতেই এই সমঝোতা হয়েছে।

‘আঁতাতে’র অভিযোগ উড়িয়ে দিয়েছেন অনুব্রত। তাঁর বরং দাবি, “মিডিয়ার কোনও কোনও অংশ অপপ্রচার করেছে। আসলে অন্যেরা হৃদয়দের ভুল বুঝিয়েছিল। ওঁরা বিষয়টা বুঝতে পেরেছে। আমি আইনকে শ্রদ্ধা করি, ভক্তি করি। আইন আইনের পথে চলবে।’’

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
আরও পড়ুন
Advertisement