ভাঙনে বিপন্ন মায়াচরের দাবি বাঁধ

দক্ষিণা বাতাস বইলেই সিঁদুরে মেঘ দেখেন মধুসূদন গুছাইত, কার্তিক গুছাইতরা। গত চার বছর ধরে এই দক্ষিণা বাতাস তাসের ঘরের মতো ধসিয়ে দিচ্ছে মায়াচরের মাটি। প্রায় একশো বছর আগে চরা পড়ে রূপনারায়ণ নদের বুকে মায়াচর নামে যে দ্বীপ গড়ে উঠেছিল ক্রমশ সেখানে বসবাস করতে শুরু করে লোকজন। রূপনারায়ণের বুকে জেগে থাকা সেই দ্বীপ আজ শস্য-শ্যামলা।

Advertisement

নুরুল আবসার

কলকাতা শেষ আপডেট: ২০ অগস্ট ২০১৪ ০২:৩৬
Share:

রূপনারায়ণের ভাঙনে এ ভাবেই পাড় ভেঙে যাচ্ছে মায়াচরের। ছবি: সুব্রত জানা।

দক্ষিণা বাতাস বইলেই সিঁদুরে মেঘ দেখেন মধুসূদন গুছাইত, কার্তিক গুছাইতরা।

Advertisement

গত চার বছর ধরে এই দক্ষিণা বাতাস তাসের ঘরের মতো ধসিয়ে দিচ্ছে মায়াচরের মাটি। প্রায় একশো বছর আগে চরা পড়ে রূপনারায়ণ নদের বুকে মায়াচর নামে যে দ্বীপ গড়ে উঠেছিল ক্রমশ সেখানে বসবাস করতে শুরু করে লোকজন। রূপনারায়ণের বুকে জেগে থাকা সেই দ্বীপ আজ শস্য-শ্যামলা। পুরোদস্তুর একটা গ্রাম। যেখানে মাটির কাঁচাবাড়ির পাশাপাশি গড়ে উঠেছে পাকা বাড়ি। তৈরি হয়েছে স্কুল, সমবায় ব্যাঙ্ক। প্রাকৃতিক ও বাস্তবের নানা প্রতিকূলতার সঙ্গে লড়াই করে বেঁচে আছেন মানুষগুলি। চাষ আবাদ, নদীতে মীন ধরা আর ইট ভাটায় কাজ করে তাঁরা নিজের মতো গড়ে নিয়েছেন জীবন। কিন্তু আজ চরের ভাঙন মানুষগুলিকে দাঁড় করিয়ে দিয়েছে অস্ত্বিত্বের সঙ্কটে।

দ্বীপের ভৌগলিক অবস্থান--পূর্ব-পশ্চিমে এর বহর সাত কিলোমিটার, উত্তর-দক্ষিণে দুই কিলোমিটার। দ্বীপের একদিকে হাওড়া জেলা। জেলার সঙ্গে দ্বীপের ব্যবধান হল ১০০ ফুট চওড়া একটি খাল। অন্যদিকে পূর্ব মেদিনীপুর। এই জেলা আর দ্বীপের মাঝে বয়ে চলেছে রূপনারায়ণ, যা নৌকায় পারাপার করতে সময় লেগে যায় আধ ঘন্টা। তুলনায় হাওড়ার কাছে হলেও প্রথম থেকেই দ্বীপটি পূর্ব মেদিনীপুর জেলা প্রশাসনেরই অধীন। বস্তুত এটিকে পূর্ব মেদিনীপুরের ছিটমহল বললেও অত্যুক্তি হবে না। দ্বীপের বাসিন্দাদের বাজারহাট থেকে শহরের সঙ্গে যোগাযোগ সবই হাওড়ার শ্যামপুরের রাধাপুরের মাধ্যমে হলেও প্রশাসনিক টিকি বাঁধা পূর্ব মেদিনীপুরে। ফলে সমস্যার অন্ত নেই মায়াচরের বাসিন্দাদের। দ্বীপে জনবসতির সংখ্যা প্রায় ৬০০০। ভোটার ৩২০০। পরিবারের সংখ্যা ১২০০। মায়াচর মহিষাদলের অমৃতবেড়িয়া গ্রাম পঞ্চায়েতের অধীন। পঞ্চায়েতের কার্যালয়ে যেতে নৌকায় প্রথমে পার হতে হয় রূপনারায়ণ। তার পরে ট্রেকারে আরও অন্তত কুড়ি মিনিট। বাসিন্দারা জানান, অনেক সময় নৌকা থাকে না। তখন সড়কপথে হাওড়ার বাগনান, কোলাঘাট, মেচেদা হয়ে আসতে হয় নিজেদের গ্রাম পঞ্চায়েত কার্যালয়ে। বিকল্প পথও আছে। সেটি হল, গাদিয়াড়ায় পৌঁছে সেখান থেকে লঞ্চে রূপনারায়ণ পার হয়ে গেঁওখালি। সেখান থেকে মহিষাদল। মোটের উপর পঞ্চায়েতের কার্যালয়ে যেতে আসতে মায়াচরের বাসিন্দাদের খরচ হয়ে যায় একটা গোটা দিন।

Advertisement

গ্রামের ভিতরের রাস্তা এমনই। —নিজস্ব চিত্র।

একমাত্র হাইস্কুলের ছাত্রছাত্রীদের মাধ্যমিক পরীক্ষা দিতে যেতে হয় মহিষাদলে। নৌকায় নদী পেরিয়ে পরীক্ষা দিতে যাওয়ায় যথেষ্ট ঝুঁকি আছে। বিপদ এড়াতে পরীক্ষা চলাকালীন ছাত্রছাত্রীদের বেশিরভাগই মহিষাদলে ঘর ভাড়া নিয়ে থাকতে বাধ্য হয়। রাতে এলাকায় চুরি-ডাকাতি বা অন্য কোনও অপরাধ হলে পুলিশের কাছে যাওয়ার উপায় নেই। কারণ, রাতে নৌকা চলে না। ফলে গ্রামের মানুষ নিজেদের স্বার্থে গড়ে নিয়েছেন ষোলোআনার বিচার ব্যবস্থা। গ্রামবাসীদের দাবি, ষোলোআনার বিচারের ফলে গ্রামে চুরি-ডাকাতি মতো অপরাধ হয় না বললেই চলে। যদিও গ্রামবাসীদেরই একাংশ জানিয়েছেন, ষোলোআনার বিচার ব্যবস্থার অস্তিত্ব এখনকার যুগে অচল। ফলে এখন গ্রামে এ সব নেই বললেই চলে।

মূল প্রশাসনের সঙ্গে যোগাযোগ ব্যবস্থার এই প্রতিকূলতার কুফল আরও বোঝা যায় গ্রামে একটি চক্কর ঘুরে এলে। উন্নয়নের ছিটেফোঁটাও নজরে এল না। গ্রামের বুক চিরে প্রায় সাত কিলোমিটার যে প্রধান রাস্তা চলে গিয়েছে তাতে একটা ইটও পড়েনি। পাড়ার ভিতরের রাস্তাগুলিও বেহাল। বর্ষায় জোয়ারের জল রাস্তার উঠে পড়ায় কাদায় থিক থিক করছে। গোটা দ্বীপে জনস্বাস্থ্য কারিগরি বিভাগের পানীয় জলের কোনও ট্যাপ চোখে পড়ল না। ২২টি নলকূপেই জলের প্রয়োজন মেটাতে হয় দ্বীপের বাসিন্দাদের। একশো দিনের প্রকল্পে কাজ করলে মজুরি আনতে যেতে হয় মহিষাদলের ব্যাঙ্কে। অমৃতবেড় গ্রাম পঞ্চায়েত সূত্রে জানা গেল, জবকার্ডধারীদের কেউ না যেতে পারলে ব্যাঙ্কের লোকজনই দ্বীপে এসে মজুরি দিয়ে যান। একইভাবে বার্ধ্যক্য ভাতা, বিধবা ভাতার টাকাও ব্যাঙ্কের লোকজন এসে দিয়ে যান বলে জানালেন বাসিন্দারা।

সাংসদের উদ্যোগে খালের উপরে তৈরি হচ্ছে কংক্রিটের সেতু।—নিজস্ব চিত্র।

তবে জীবনযাপনের যাবতীয় সমস্যার থেকে সবচেয়ে বড় বিপদ হয়ে দেখা দিয়েছে রূপনারায়ণের ভাঙন। মধূসূদনবাবু, কার্তিকবাবুর কথায়, “বংশ পরম্পরায় এই দ্বীপের বাসিন্দা। দ্বীপকে আবাদ করেছি। কিন্তু দ্বীপ যদি নদীগর্ভে তলিয়ে যায় তা হলে আমরা কোথায় যাব?’’ গ্রামবাসীরা জানান, উত্তর দিকের পাড়ের অনেক অংশই গত চার বছর ধরে ভাঙনে চলে গিয়েছে রূপনারায়ণের করাল গ্রাসে। নদীগর্ভে বিলীন হয়েছে কয়েক হাজার বিঘা জমি, অন্তত ১০০টি বাড়ি, একটি স্কুল। প্রতি বছর গরমে দক্ষিণা বাতাস বওয়ার সঙ্গে সঙ্গে পাড়ের ভাঙন দেখা দেয় বলে জানালেন গ্রামবাসীরা। এই এলাকা তমলুক লোকসভার অধীন। নির্বাচন এলে তমলুক থেকে মায়াচরে আসে প্রচার করতে আসেন রাজনৈতিক দলগুলির নেতানেত্রীরা। অবশ্য নদীপথে নয়, মেচেদা, কোলাঘাট, বাগনান হয়ে আসেন সড়কপথে। সদ্য লোকসভা নির্বাচনের সময় প্রচারে এসেছিলেন তৃণমূল প্রার্থী শুভেন্দু অধিকারী। তাঁর উদ্যোগেই হলদিয়া ডেভেলপমেন্ট অথরিটি ১ কোটি ৬৭ লক্ষ টাকা খরচ করে মায়াচরের সঙ্গে হাওড়ার রাধাপুরের যোগাযোগকারী খালের উপরে কংক্রিটের সেতু তৈরি করছে।

তবে সেতুর মাধ্যমে হাওড়ার সঙ্গে তাঁদের সড়ক যোগাযোগ পাকা হলেও মায়াচরের মানুষ প্রশাসনিক সুযোগ-সুবিধার জন্য পূর্ব মেদিনীপুরের সঙ্গেই থাকতে চান। মায়াচর থেকে টানা তিনবার পঞ্চায়েতের সদস্য নির্বাচিত হওয়া মধূসুদনবাবু বলেন, ‘‘এখানে যাঁরা বসবাস করেন তাঁদের পূর্বপুরুষেরা প্রায় সকলেই পূর্ব মেদিনীপুরের বিভিন্ন এলাকা থেকে এসে এখানে বসতি গড়ে তুলেছিলেন। সেচ দফতর যেন বাঁধ দিয়ে এই দ্বীপকে রক্ষা করুক, এটাই আমাদের একমাত্র দাবি।’’

সেচ দফতরের তমলুক ডিভিশন সূত্রে অবশ্য বলা হয়েছে, মায়াচরের ভাঙন রুখতে নদীতে বাঁধ দেওয়ার ব্যবস্থা হচ্ছে।

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
আরও পড়ুন
Advertisement