উদ্ধারের পরে জোর করে লিলুয়া হোমে ঢোকানোর চেষ্টা এক আবাসিককে। বৃহস্পতিবার। —নিজস্ব চিত্র।
পনেরো দিনের মধ্যে চার বার। লিলুয়া হোম থেকে পালানোর চেষ্টা করেছেন মেয়েরা। অবশেষে সরকারের উপলব্ধি হয়েছে: ওই হোমে কর্তৃপক্ষের গাফিলতির পাশাপাশি রয়েছে চরম অব্যবস্থাও। সেখানে আবাসিকদের খাওয়াদাওয়া নিয়েও যেমন সমস্যা রয়েছে, তেমনই ঘাটতি রয়েছে নিরাপত্তাতেও।
গত ২৫ জুলাই ভোরে রাজ্য সরকার পরিচালিত এই লিলুয়া হোম থেকেই আবাসিক পালানোর চেষ্টা করেছিলেন ৩৫ জন। এক সপ্তাহ কাটতে না কাটতেই বৃহস্পতিবার দু’দফায় ফের যথাক্রমে ৬ জন ও ৭ জন আবাসিক পালানোর চেষ্টা করলেন। আর সেই ঘটনাকে কেন্দ্র করে এ দিনও রণক্ষেত্রের চেহারা নিল হোম চত্বর। পুলিশ ও হোমকর্মীদের লক্ষ করে ইট বৃষ্টি, দরজা-জানলা ভাঙচুরের অভিযোগ উঠেছে আবাসিকদের বিরুদ্ধে। গত ২১ জুলাই রাতেও পালানোর চেষ্টা করেছিলেন ২৫ বাংলাদেশি মহিলা।
এক মাসের মধ্যে পরপর চার বার আবাসিক পালানোর চেষ্টার পরে অবশ্য নড়েচড়ে বসেছে প্রশাসন। তাই এ দিনের ঘটনার পরে বাস্তব পরিস্থিতি খতিয়ে দেখতে হোমে যান রাজ্যের নারী, শিশু ও সমাজকল্যাণ মন্ত্রী শশী পাঁজা। হোম কর্তৃপক্ষের সঙ্গে বৈঠকের পাশাপাশি আবাসিকদের সঙ্গেও দেখা করে কথা বলেন তিনি। তখনই কয়েক জন আবাসিক হোমের অব্যবস্থা নিয়ে মন্ত্রীর হাতে অভিযোগের চিঠি তুলে দেন। মন্ত্রী জানান, এ দিন প্রতিটি মেয়েকে উদ্ধার করা সম্ভব হলেও আগের দু’টি ঘটনায় মোট ৫ জন মেয়ে এখনও নিখোঁজ।
কিন্তু তার পরেও বৃহস্পতিবারই রাত দশটা নাগাদ ৭ জন আবাসিক পালানোর চেষ্টা করেন। হোম সূত্রের খবর, তাঁরা সকাল থেকেই পাঁচিলের পাশে লুকিয়েছিলেন। যদিও তাঁদের সবাইকেই ধরা গিয়েছে। এক জনকে পালানোর সময়েই ধরে ফেলেন হোমের এক জন মহিলা পুলিশ কনস্টেবল। বাকিদের রাত সাড়ে দশটা নাগাদ ধরেন বেলুড় থানার পুলিশ ও রেডিও ফ্লাইং স্কোয়াড।
হোম সূত্রের খবর, কিছু দিন আগে হলদিয়া থেকে ২৮ জন মেয়েকে এই হোমে আনা হয়েছিল। গত ২১ জুলাই তাঁদের মধ্যে দু’জনকে হলদিয়া আদালতে নিয়ে যাওয়ার তারিখ ছিল। ওই মেয়েরা দাবি করেন, একই দিনে একসঙ্গে তাঁদের ২৮ জনকেই আদালতে পাঠাতে হবে। কর্তৃপক্ষ তা মেনে না নেওয়ায় ২৫ জুলাই ভোরে হোমের মধ্যেই বিক্ষোভ শুরু করেছিলেন ওই ২৮ জন আবাসিক। তাঁরা হোমের কর্মীদের ধারালো অস্ত্র নিয়ে মারতে যান। প্রাণে বাঁচতে দরজা খুলে দিয়েছিলেন কর্মীরা। এর পরেই হোমের পিছন দিকের সীমানা-পাঁচিল লাগোয়া একটি বটগাছ বেয়ে মোট ৩৫ জন আবাসিক পালিয়ে যান। পুলিশ ও হোম কর্মীদের তৎপরতায় ৩২ জনকে উদ্ধার করা হয়েছিল। এর আগে গত ২১ জুলাই রাতে দোতলার শৌচাগারের জানলার গ্রিল কেটে ওড়না বেঁধে নেমে ওই গাছটি বেয়েই পাঁচিল টপকে পালিয়েছিলেন ২৫ জন বাংলাদেশি মেয়ে। পরে ২৩ জনকে উদ্ধার করা হয়। জেলা প্রশাসন সূত্রের খবর, ২৫ জুলাইয়ের ঘটনার পর ওই হোমে পুলিশি নিরাপত্তার ব্যবস্থা করা হয়েছিল। তা সত্ত্বেও এ দিন ফের আবাসিক পালানোর ঘটনা রুখতে পারেননি কর্তৃপক্ষ।
হোম সূত্রে জানা গিয়েছে, এ দিনও হলদিয়ার ৮ জনকে আদালতে পাঠানোর তারিখ ছিল। কেন তাঁদের এক সঙ্গে আদালতে পাঠানো হবে না, তা নিয়েই বুধবার রাত থেকেই ফের ক্ষিপ্ত হয়েছিলেন ওই মেয়েরা। তাঁদের প্রত্যেককে ‘নারী পাচার’ ব্লকে রাখা হয়েছিল। অভিযোগ, এ দিন সকাল সাড়ে ৯টা নাগাদ কয়েক জন মেয়ে পানীয় জল নিতে বেরিয়ে ব্লকের কোল্যাপসিব্ল দরজার লক ভেঙে দেন। এর পরেই সকলে মিলে বাইরে বেরিয়ে বিক্ষোভ শুরু করেন তাঁরা। যোগ দেন ক’জন বাংলাদেশি মেয়েও। ফের শুরু হয় বিক্ষোভ-ভাঙচুর।
আগের দিনের ঘটনার পরে পাঁচিল লাগোয়া বটগাছের ডালপালা ছাঁটা হয়েছিল। কিন্তু এ দিন সেই গাছে ওড়না বেঁধে পাঁচিল টপকে বাইরে বেরিয়ে যান ৬ জন আবাসিক। খবর যায় পুলিশে। প্রায় আধ ঘণ্টা পরে সকলকেই উদ্ধার করে হোমে ফিরিয়ে আনা হয়। ইতিমধ্যে বাকি আবাসিকেরা বিক্ষোভ শুরু করে দিয়েছিলেন। সীমানা-পাঁচিলের উপর উঠে পড়েন কয়েক জন আবাসিক। হোম চত্বরে রাস্তা তৈরির জন্য আনা পেপার ব্লক ভেঙে সেগুলি পাঁচিলের বাইরে থাকা পুলিশ ও কর্মীদের লক্ষ করে ছুড়তে শুরু করেন মেয়েরা। পুলিশবাহিনী গিয়ে পরিস্থিতি সামাল দেয়। কিন্তু রাতে আবার একই ঘটনা ঘটে।
কিন্তু বারবার কেন পালাতে চেষ্টা করছেন আবাসিকেরা?
আবাসিকদের অভিযোগ, তাঁদের ঠিক মতো খাবার দেওয়া হয় না, অসুস্থ হলে চিকিৎসা করানো হয় না, বাড়ির লোকের সঙ্গে যোগাযোগ করতে দেওয়া হয় না, ফোন করতে চাইলে মারধর জোটে। এমনকী, কিছু পুরুষ কর্মী তাঁদের সঙ্গে অশালীন আচরণ করেন বলেও অভিযোগ উঠেছে। এ ছাড়াও বিনা দোষে কোনও বিচার ছাড়াই দীর্ঘদিন ধরে তাঁদের এই হোমে আটকে রাখা হয়েছে বলেও অভিযোগ করেন আবাসিকেরা।
এ দিন সকালের ঘটনার পরেই লিলুয়া হোমে ছুটে যান জেলা প্রশাসনের কর্তা ও পদস্থ পুলিশকর্তারা। পরে পৌঁছন মন্ত্রী শশী পাঁজাও। প্রায় দু’ঘণ্টা ধরে তিনি ওই হোমে ছিলেন। পরে বাইরে বেরিয়ে মন্ত্রী বলেন, “মেয়েরা দীর্ঘ দিন এখানে রয়েছেন। ওঁরা তাড়াতাড়ি বাড়ি ফিরতে চান। কিন্তু তা সম্ভব হচ্ছে না বলেই মেয়েরা বারবার পালানোর চেষ্টা করছেন। যেমন হলদিয়ার ২৮টি মেয়ের মধ্যে কয়েক জন দাবি করেছেন, তাঁরা কোনও অপরাধের সঙ্গে যুক্ত না হয়েও আটকে আছেন। বাংলাদেশি মেয়েরাও দীর্ঘদিন আটকে থাকায় ধৈর্য হারাচ্ছেন।”
কিন্তু দীর্ঘদিন ধরে এই হোমে অব্যবস্থার অভিযোগ ওঠা সত্ত্বেও রাজ্য সরকার এত দিন ব্যবস্থা নেয়নি কেন? বাম আমলেও হোমের অব্যবস্থা নিয়ে যে অভিযোগ ছিল, রাজ্যে ক্ষমতার পরিবর্তনের পরেও তার বদল হয়নি। প্রতি বছর হোমের উন্নয়নে লক্ষ লক্ষ টাকা বরাদ্দ করা হলেও হোমের উন্নয়ন না করে সেই টাকা কোথায় যাচ্ছে, প্রশ্ন উঠেছে তা নিয়েও। হাওড়া জেলা ক্রিমিনাল কোর্ট বার অ্যাসোসিয়েশনের সভাপতি সমীর বসুরায়চৌধুরী বলেন, “লিলুয়া হোমে এত বড় জায়গা পড়ে থাকলেও তা সঠিক ভাবে ব্যবহার করা হচ্ছে না। নিরাপত্তার ব্যবস্থা আরও জোরদার করা দরকার। টাকা অনুমোদন হলেও কাজ হয়নি।”
অব্যবস্থার কথাও এ দিন স্বীকার করেছেন মন্ত্রী। তিনি বলেন, “হোম পরিচালনায় কর্তৃপক্ষের আরও সক্রিয় হওয়া উচিত ছিল। এখানে নিরাপত্তার ঘাটতি রয়েছে। খাবারদাবার নিয়েও অভিযোগ রয়েছে। সমস্ত বিষয়ে ব্যবস্থা নিচ্ছি।” মন্ত্রী জানান, হলদিয়ার মেয়েদের দাবি যেমন গুরুত্ব সহকারে দেখা হচ্ছে, তেমনি ২৫ জন বাংলাদেশির মুক্তির প্রক্রিয়া দ্রুত করারও ব্যবস্থা হচ্ছে। ইতিমধ্যেই ১৩ জনের মুক্তির প্রক্রিয়া সম্পূর্ণ। কিন্তু তা সত্ত্বেও তিন জন এ দিন পালানোর চেষ্টা করেছিলেন।