কান্নায় ভেঙে পড়েছেন বাবা সুশান্ত কানু।—নিজস্ব চিত্র
বাড়ির পছন্দের পাত্রকে ছেড়ে তাঁর প্রেমিককে বিয়ে করেছেন তরুণী। তাই ‘ঘটা’ করে মেয়ের শ্রাদ্ধ করলেন বাবা। ভ্যালেন্টাইন্স ডে-তে এই ঘটনা ঘটেছে হাওড়ার জগাছায়।
প্রেমিক সুপ্রতিষ্ঠিত নন। ভাল ব্যবসা বা বড় চাকরি, কিছুই নেই। বংশমর্যাদা ও অর্থবলেও পিছিয়ে। এই যুক্তিতে মেয়ের প্রেমিককে প্রত্যাখ্যান করেছিলেন পরিবারের সকলে। তড়িঘড়ি সুপাত্র দেখে মেয়ের বিয়েও ঠিক করে ফেলেছিলেন তাঁরা। বিয়ের কেনাকাটা থেকে নিমন্ত্রণ, হয়ে গিয়েছিল সবই। কিন্তু বিয়ের ক’দিন আগে সেই তরুণী বাড়ি থেকে পালিয়ে প্রেমিককে বিয়ে করেন।
এ পর্যন্ত সবটাই পরিচিত। এমনটা ঘটেই থাকে। কিন্তু শেষটা যা হল, তা সিনেমাতেও বিশেষ দেখা যায় না।
তরুণীর বাড়ি ছেড়ে চলে যাওয়ার দিনেই তাঁকে মৃত বলে ঘোষণা করেন বাবা-মা। ১২ দিন পরে মেয়ের শ্রাদ্ধানুষ্ঠানের আয়োজনও করলেন তাঁরা। ঘটনাচক্রে সেটি পড়ল শনিবার, ভালবাসার দিন ভ্যালেন্টাইন্স ডে-তে।
এ দিন অশৌচান্তের সমস্ত নিয়ম মেনে পরিবারের সমস্ত পুরুষের মাথা মুণ্ডন করা হয়। রীতিমতো পুরোহিত ডেকে জীবিত তরুণীর শ্রাদ্ধানুষ্ঠান হয়। এমনকী, সাদা কাপড়ের প্যান্ডেল তৈরি করে আত্মীয়দের খাওয়াদাওয়ারও ব্যবস্থা করেন বাবা-মা।
পুলিশ ও স্থানীয় সূত্রে খবর, এলাকার বাসিন্দা বৈদ্যুতিক সরঞ্জামের ব্যবসায়ী সুশান্ত কানুর একমাত্র মেয়ে জয়ন্তী কানুর সঙ্গে ভালবাসার সম্পর্ক হয় স্থানীয় ধাড়সার বাসিন্দা রাজু সরকারের। বছর বাইশের রাজু একটি বেসরকারি সংস্থার কর্মী।
পুলিশ জানায়, সম্প্রতি তাঁদের সম্পর্কের বিষয়টি জানাজানি হতে বেঁকে বসেন জয়ন্তীর পরিজনেরা। তাঁর অমতেই বিয়ে ঠিক করে ফেলেন লিলুয়ার এক যুবকের সঙ্গে। আগামী ২৭ ফেব্রুয়ারি বিয়ে ঠিক হয় তাঁদের। সেই মতো বিয়ের কেনাকাটা ও নিমন্ত্রণও সেরে ফেলে ওই তরুণীর পরিবার। কিন্তু গত ৩ তারিখ ভোরবেলা নিজের প্রয়োজনীয় জিনিসপত্র সঙ্গে নিয়ে বাড়ি ছেড়ে বেরিয়ে যান জয়ন্তী। গিয়ে ওঠেন রাজুর বাড়িতে। রাজুর সঙ্গে তাঁর বিয়েও হয়ে যায়।
পুলিশ জানায়, এ খবর জানতে পেরে ওই তরুণীর বাবা জাগাছা থানায় তাঁর নাবালিকা মেয়েকে ফুঁসলিয়ে নিয়ে যাওয়ার অভিযোগ দায়ের করেন। অভিযোগ পেয়ে পুলিশও তদন্তে যায় তরুণীর শ্বশুরবাড়িতে। কিন্তু সেখানে ওই তরুণী নিজের জন্মের সার্টিফিকেট দেখিয়ে জানান, দু’দিন আগেই তাঁর বয়স আঠেরো পেরিয়েছে। এর পরে পুলিশের আর কিছু করার থাকে না।
শনিবার জগাছার গভর্নমেন্ট প্রেসের কাছে ওই তরুণীর বাড়ির সামনে গিয়ে দেখা যায়, সামনের মাঠে শ্রাদ্ধবাড়ির মতো প্যান্ডেল হয়েছে। লোকজন খাওয়াদাওয়া করছেন। সব কিছু তদারকি করছেন মেয়ের বাবা সুশান্তবাবু ও কাকা প্রশান্ত কানু। তাঁদের দু’জনেরই মাথা সদ্য মুণ্ডন করা হয়েছে। সুশান্তবাবু বলেন, “ও আমাদের মানসন্মান কিছুই রাখেনি। অনেক কষ্ট দিয়েছে। তাই আমার কাছে মেয়ে মৃত। এ জন্যই শ্রাদ্ধ করছি।”
দাদার পাশে দাঁড়ানো প্রশান্তবাবু বলেন, “আমরা এই অপমান সহ্য করতে পারিনি। এটা আমাদের প্রতিবাদ।” তবে এই ঘটনা যে মেনে নিতে পারেনি এলাকার বাসিন্দারা, তা তাঁদের কথাতেই পরিষ্কার। স্থানীয় যুবক প্রসেনজিৎ দাস বলেন, “এটা মারাত্মক সামাজিক অপরাধ করছে কানু পরিবার। ওঁদের শাস্তি হওয়া প্রয়োজন। আমরা এটা কিছুতেই মেনে নেব না।”
রাজুর বন্ধু শেখর সূত্রধর বলেন, “রাজু-জয়ন্তীর অপরাধটা কী? ওঁরা ভালবেসে বিয়ে করেছে। এ জন্য জীবিত মেয়ের শ্রাদ্ধ করতে হবে?”
কিন্তু এই ঘটনার প্রতিবাদ করতে আগে এগিয়ে যাননি কেন?
শেখর বলেন, “ওই পরিবারের সঙ্গে পাড়ার কারও ভাল সম্পর্ক নেই। তা ছাড়া, এটা ওঁদের পারিবারিক ব্যাপার ভেবে আমরা কেউ যাইনি।”
রাজুর মাসতুতো ভাই উজ্জ্বল দলুই বলেন, “জয়ন্তীর বাবা যা করেছেন, তা লজ্জাজনক।” এ ব্যাপারে রাজুকে ফোন করা হলে তিনি অবশ্য কোনও মন্তব্য করতে চাননি।
এ বিষয়ে সমাজতত্ত্বের শিক্ষক অভিজিৎ মিত্রের বক্তব্য, এলাকার মানুষেরই আগে প্রতিবাদ করা দরকার ছিল। তিনি বলেন, “সমাজবোধ এত দুর্বল হয়ে যাচ্ছে যে, এত বড় ঘটনা দেখেও প্রতিবাদের ভাষা থাকছে না।”