চন্দননগরের আদি হালদারপাড়ার প্রতিমা।
সরু গলি। চওড়ায় বড়জোর ৬ ফুট। তিলধারণের জায়গা নেই।
সেই সরু গলিপথ ধরেই ভিড় এগোচ্ছে শম্বুকগতিতে। কিছুটা এগোতেই দর্শনার্থীদের বিস্ময়, ‘‘এখানে এমন মণ্ডপ!’’
বিশালাকার ফুটন্ত পদ্ম থেকে নরম আলো বিচ্ছুরিত হচ্ছে চার পাশে। নীচে গোলাকার জলাশয়ে রঙিন মাছের দাপাদাপি। ছোট্ট সাঁকো পেরিয়ে মণ্ডপের ভিতরে ঢুকলে মনে হবে এ যেন কোনও ‘ফুলের দেশ’! প্রতিমার অধিষ্ঠানও পদ্মবেদিতে।
জি টি রোড ধরে এগোলে বারাসত গেটের অদূরেই কৃষ্ণপট্টি। গতবার ‘বরফের দেশ’ বানিয়ে তারা দর্শকদের তাক লাগিয়ে দিয়েছিল। এ বারও সেই চমক ধরে রাখার আপ্রাণ চেষ্টা ফুটন্ত পদ্মের মণ্ডপ বানিয়ে। পুজো কমিটির পক্ষে ইন্দ্রনীল ঘোষ জানান, এ বার পুজো ৪২ বছরে পড়ল। গতবারের ভিড় দেখে এবং নতুন কিছু করার তাগিদেই তাঁদের এই প্রচেষ্টা।
এখানকার ভিড়টাই আগে-পরে ঢুকছে জি টি রোডের ধারে, বারসত গেট সর্বজনীনে। বর্তমান সময়ে বিশ্বের নানা প্রান্তে যে হানাহানি চলছে, তারই প্রতিবাদে ‘ঐক্যের খোঁজে’ নেমেছেন পুজো উদ্যোক্তারা। থিম, ‘ঐক্য সাধনে মুক্তি’। নানা ধর্মের মানুষের মডেল দিয়ে খেজুর পাতা, তালপাতা, হোগলাপাতা, হাতপাখা, মাদুরকাঠি দিয়ে সাজানো মণ্ডপ পুজো কমিটির পক্ষে সঞ্জয় ভট্টাচার্য বলেন, ‘‘চার দিকে যে ভাবে হানাহানি চলছে, তা বন্ধের জন্যই আমাদের এই ভাবনা।’’
তবে, শুধু কৃষ্ণপট্টি বা বারাসত গেট সর্বজনীনই নয়, দক্ষিণ চন্দননগরের বড় পুজোগুলির মধ্যে ভিড় টানার প্রতিযোগিতা শুরু হয়ে গিয়েছিল সেই ষষ্ঠীর সকাল থেকেই। সপ্তমীর রাতে জনস্রোত। পূর্ব রেলের হাওড়া-ব্যান্ডেল শাখার মানকুণ্ডু স্টেশনে নেমে দর্শনার্থীরা দক্ষিণ চন্দননগরের প্রথম যে মণ্ডপে ভিড় জমাচ্ছেন, তা মানকুণ্ডু স্পোর্টিং ক্লাব। রাস্তার পাশে বিশাল মাঠে গোলাকার মণ্ডপ দেখে হাঁ হয়ে গিয়েছিল শেওড়াফুলির বছর আটেকের প্রীতম দাস। বাবা-মায়ের সঙ্গে এ বারই প্রথম চন্দননগরের জগদ্ধাত্রী পুজো দেখতে এসেছে। তার কথায়, ‘‘আজ সারারাত ঠাকুর দেখব। সকালে বাড়ি ফিরে যাব। বন্ধুদের এখানকার ছবি দেখাব। কত রং, তুলি, পেন্সিল, লজেন্স!’’
গোলাকার মণ্ডপে মানকুণ্ডু স্পোর্টিং ক্লাব থিম করেছে ‘চাঁদমামার দেশে’। মণ্ডপ যেন ছোটদের দুনিয়া! পুজো কমিটির সভাপতি দীপক চক্রবর্তী জানান, ছোটদের মন জয় করতেই বেশি গুরুত্ব দিয়েছেন তাঁরা।” অবশ্য বড়রাও উচ্ছ্বসিত মণ্ডপ দেখে। এখান থেকে কিছুটা এগোলেই গড়ের ধারে নতুনপাড়া সর্বজনীন। নানা রঙের সুতো এবং আলোর খেলায় দর্শকদের যেন ‘বরফের দেশ’-এ নিয়ে যাওয়ার চেষ্টা করেছেন উদ্যোক্তারা। মণ্ডপে ঢুকলে প্রথমেই চোখে পড়বে তিনটি বিশালাকার কল্কে ফুল। মণ্ডপের ছাদ দিয়ে ঢুকছে আলোক রশ্মি। ঝুলন্ত সুতোয় সেই আলো প্রতিফলিত হয়ে বরফ পড়ার আমেজ সৃষ্টি করছে! যা দেখে দর্শনার্থীরা চমকাচ্ছেন। মুখে হাসি উদ্যোক্তাদের। পুজো কমিটির সহ-সভাপতি জয়দীপ ভট্টাচার্যের কথায়, “দর্শকদের আনন্দ দিতে পেরে ভাল লাগছে।”
দক্ষিণ চন্দননগরের নিয়োগীবাগান নব বালক সঙ্ঘের মণ্ডপ রাজস্থানী দুর্গের আদলে। রাজস্থানী লোকগানের শিল্পীরা যে রকম পোশাক পরেন, শিঙা-সহ নানা বাদ্যযন্ত্র বাজান মণ্ডপে হাজির করা হয়েছে সে সব। এর সঙ্গে মেশানো হয়েছে বাংলার পটশিল্প। অবশ্য উত্তর চন্দননগরের হালদারপাড়া ষষ্ঠীতলার মণ্ডপেও রাজস্থানের প্রাসাদের আদল।
বৈচিত্র্য রয়েছে আরও। তার টানেই দর্শনার্থীরা রাতভর পথ হাঁটেন। ক্লান্ত হয়ে পড়লে ক্ষণিক বিশ্রাম। ঠান্ডা পানীয় বা গরম কফিতে গলা ভেজানো। এ ভাবেই নিয়োগীবাগান থেকে প্রায় এক কিলোমিটার দূরে দক্ষিণ চন্দননগরের সার্কাস মাঠ সর্বজনীনেও হাজির হচ্ছেন তাঁরা। আলোক স্রোতে ভাসছে রাজপথ। সেই আলো ঠিকরে পড়ছে সার্কাস মাঠের পেখম তোলা বিশাল ময়ূরে। এটাই এখানকার মণ্ডপ। ভিতরে হাঁস-পেঁচা, গাধা, ঘোড়া নিয়ে পুরোপুরি প্রাণিজগত্। বিপন্ন মত্স্যকুলকে তুলে ধরেছে অম্বিকা অ্যাথলেটিক।
জমে গিয়েছে পুজো।
জগদ্ধাত্রী পুজোর আরও ছবি। ছবিগুলি তুলেছেন তাপস ঘোষ।