খ্যাতির সঙ্গী বঞ্চনাও, তবু আড়ালই পছন্দ অনির

‘অনি জলকে গেছে। কখন ফিরবেক জানি নাই। তা ওর আসতি রাত হবেক।’ টানা তিনদিন ধরে চেষ্টা করেও কিছুতেই ওঁকে জলের বাইরে পাওয়া যাচ্ছিল না। উপায় না দেখে শেষে বাড়িতেই হানা। সিঙ্গুরের গোপালনগরের প্রত্যন্ত এলাকায় পশ্চিমপাড়া তালপুকুর ধারে বাড়ি অনিমা ওঁরাওয়ের। এক ডাকে গ্রামে সবাই তাঁকে চেনে অনি নামে।

Advertisement

গৌতম বন্দ্যোপাধ্যায়

সিঙ্গুর শেষ আপডেট: ০৯ মার্চ ২০১৫ ০০:৫৯
Share:

অনিমার বাড়ি। দারিদ্রের ছাপ সর্বত্র। ছবি: দীপঙ্কর দে।

‘অনি জলকে গেছে। কখন ফিরবেক জানি নাই। তা ওর আসতি রাত হবেক।’

Advertisement

টানা তিনদিন ধরে চেষ্টা করেও কিছুতেই ওঁকে জলের বাইরে পাওয়া যাচ্ছিল না। উপায় না দেখে শেষে বাড়িতেই হানা। সিঙ্গুরের গোপালনগরের প্রত্যন্ত এলাকায় পশ্চিমপাড়া তালপুকুর ধারে বাড়ি অনিমা ওঁরাওয়ের। এক ডাকে গ্রামে সবাই তাঁকে চেনে অনি নামে। বাড়ি বলতে মাটির প্রলেপ দেওয়া দেওয়ালের মাথায় টালির চালা। সাত ভাইবোনের মধ্যে সবচেয়ে ছোট চম্পা মানে অনি। বাবা বেথান মারা গিয়েছেন প্রায় ন’ বছর। মা লুন্দ্রেরী খেতমজুর। এ বাড়ির মহিলাদের প্রায় সবাই খেতমজুরি করেন। নিতান্ত দারিদ্রের ভাঙা ঘরে এক টুকরো চাঁদের আলো অনি। আর দারিদ্রের এমন প্রতিকূল অবস্থাই অনিমাকে সাহস জুগিয়েছে এগিয়ে চলার পথে। তব যতটা সহজে বলা গেল ততটা সহজ নয় অনির লড়াই।

কাকভোরে সাইকেলে প্রায় পাঁচ কিলোমিটার দূরে কামারকুন্ডু রেল স্টেশন। সেখান থেকে ট্রেন পাল্টে বিরাটি। গত এক বছর এই রোজনামচাতেই অভ্যস্ত অনি। দশ বারেরও বেশি সময় জাতীয় স্তরের বিভিন্ন প্রতিযোগিতায় পা রেখেছে সে। এখন তার সারাদিনের ঠিকানা বিরাটির একটি সাঁতার প্রশিক্ষণ কেন্দ্র। ছোটদের সাঁতার প্রশিক্ষকের কাজ করে অনি। ভবিষ্যতের অনিদের তৈরির দায়িত্ব এখন তার কাঁধে।

Advertisement


অনিমা ওঁরাও।

দিনআনা দিনখাওয়ার পারিবারিক বৃত্তে বেড়ে ওঠা অনির সাঁতারের প্রথম পাঠ বাড়ির কাছেই বোসপুকুরে। এক সময় সিঙ্গুর থেকে রিষড়া হয়ে কোন্নগর সুইমিং ক্লাব। সেখান থেকেই সাঁতারে জাতীয় স্তরে পা রাখা। মাঝে চড়াই-উতরাই অনেকটা গল্পের মতো। পড়াশোনা দৌলতপুর দলুইগাছা ভারতী বিদ্যালয়ে। টাকার অভাবে পড়াশানার দৌড়ে পিছিয়ে পড়তে বাধ্য হলেও সাঁতারে লম্বা দৌড়ের বিজয়ীনি তিনি। দিদি লিপিকাও সাঁতারে যথেষ্ট কৃতি ছিলেন। ভারতের হয়ে প্রতিনিধিত্ব করেছেন। তাই পরিবারিক আবহই অনিকে অনেকটাই সাহায্য করেছে জলকে আপন করে নিতে। যার নেপথ্যে প্রশিক্ষক লক্ষ্মণ ঢেঁকির ভূমিকাও যথেষ্টই উজ্জ্বল বলে জানালেন দাদা শীতল। বোনেদের সাঁতারে উত্‌সাহ দিতে যাঁর ভূমিকাও কিছু কম নয়। আক্ষেপ ঝরে পড়ল গলায়, “আমি সবার বড়। দুই বোন জাতীয় এবং আন্তর্জাতিক স্তরে এত কৃতি হলেও সরকারি ক্ষেত্রে সেই ভাবে কোনও সাড়া পাইনি। বলতে পারেন, ওদের এই উঠে আসা আমাদের ওঁরাও পরিবারের একক লড়াইয়ের ফল।” মা লুন্দ্রেরী বলছিলেন, “ঘরে মেয়ের মেডেল রাখার জায়গা নেই। তা ও সেগুলো সুটকেসে তালাবন্দি করে রাখে।”

অনিমা অবশ্য অনেকটাই প্রচারবিমুখ। সংবাদমাধ্যম, ছবি তোলাসবেতেই তার আপত্তি। অনেক অনুরোধের পরেও প্রশিক্ষণের ছবি তুলতে দিতে রাজি হল না। হালকা হাসির ফাঁকে বারে বারেই নিরস্ত করার চেষ্টা, ‘‘কি হবে এ সব করে! আমি তো আমার কাজ করছি।” পথচলার এই কঠিন গদ্যেই নিজেকে মানিয়ে নিয়েছে অনি।

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
আরও পড়ুন
Advertisement