উলুবেড়িয়া রবীন্দ্রভবন
যখন নাটকের দল নিয়ে মাতামাতি ছিল শহরজুড়ে, তখন ছিল না বড়সড় কোনও প্রেক্ষাগৃহ। শেষমেশ যখন বছর পাঁচেক আগে মাথা তুলে দাঁড়াল রবীন্দ্রভবন, তখন ‘অনিকেত’, ‘অন্বেষণ’, ‘উদ্দীপন’, ‘আগামী’, ‘বীক্ষণ’-এর মতো নাট্যগোষ্ঠীরা অদৃশ্য, নইলে স্তিমিত। সাংস্কৃতিক আন্দোলনই গতি হারিয়েছে উলুবেড়িয়ায়।
সাতের দশকের সেই উত্তাল দিনগুলোর কথা বলতে গেলে এখনও অন্য রকম হয়ে যান প্রবীর দত্ত, সুপ্রিয় ধর, অনুপ চক্রবর্তীর মতো নাট্যপ্রমীরা। কতই বা বয়স তখন তাঁদের, বড়জোর উনিশ-কুড়ি। নিজেরা দল গড়ে নাটক করতেন, আয়োজন করা হত নাট্য প্রতিযোগিতার। কোনও প্রেক্ষাগৃহ ছিল না। কিন্তু তাতে কী! উলুবেড়িয়া কলেজের ছাদ তো আছে। সেখানেই বানাও মঞ্চ। অভিনেতা, অভিনেত্রী, দর্শক সকলেরই ঠাঁই ছাদে। ‘‘নাট্য আনন্দে ভেসে যাওয়ার সে এক মহা সুখ।’’ বলছিলেন সুপ্রিয়বাবু, অনুপবাবুরা।
আজ গঙ্গার ধারে গড়ে উঠেছে ঝাঁ চকচকে রবীন্দ্রভবন। নাটক করার জায়গার অভাব নেই। কিন্তু কারা করবে নাটক? গোষ্ঠীই তো আর নেই। সুপ্রিয়বাবুর নাটকের গোষ্ঠী ‘অনিকেত’ কবেই পাততাড়ি গুটিয়েছে। অনুপবাবুর গোষ্ঠী ‘উদ্দীপন’ টিকে রয়েছে, কিন্তু নানা সমস্যায় জর্জরিত। গড়ে উঠেছিল মহিলাদের সাংস্কৃতিক সংগঠন ‘মুক্তধারা’। রবীন্দ্রনাথের চণ্ডালিকা-সহ কত যে নাটক বছরভর এই সংস্থার সদস্যরা করেছেন, তার হিসেব নেই। এখন সদস্যই জোটে না। একই দশা শহরের অন্য নানা দলেরও।
রবীন্দ্রভবনের মালিকানা পুরসভার। গত ২৬ জুলাই পুরবোর্ড ভেঙে গিয়েছে। প্রাক্তন বোর্ডে রবীন্দ্র ভবনের দায়িত্বপ্রাপ্ত কাউন্সিলর আব্বাসউদ্দিন খান বলেন, “সাংস্কৃতিক সংস্থা ও ক্লাবগুলিকে বহু বার চিঠি দিয়েছি যোগাযোগ করে অনুষ্ঠান করার জন্য। কিন্তু উলুবেড়িয়ায় সাংস্কৃতিক আন্দোলন সে ভাবে নেই।” শহরের প্রাণকেন্দ্রে অবস্থিত ঝাঁ চকচকে রবীন্দ্রভবন তাই বছরের বেশির ভাগ সময় গমগম করে রাজনৈতিক দল, স্বেচ্ছাসেবী সংস্থা, ট্রেড ইউনিয়নের আলোচনা সভায়।
শুধু নাটকই নয়, উলুবেড়িয়া শহরে সাতের দশকের শুরু থেকে আটের দশকের শুরু পর্যন্ত বহু সাংস্কৃতিক কর্মকাণ্ড চালু ছিল বলে জানালেন স্থানীয় সংস্কৃতিপ্রেমীরা। ওই সময়েই গড়ে উঠেছিল আবৃত্তি সংসদ। সংসদের উদ্যোগে শহরে বসত আবৃত্তির আসর। আবৃত্তি নিয়ে চলত নিয়মিত পরীক্ষা-নিরীক্ষা। শহরে টানা ১২ বছর ধরে আয়োজিত হয়েছে বইমেলা। বইমেলা উপলক্ষে শহরে এসেছেন বহু বিখ্যাত লেখক। ক্রমে বন্ধ হয়ে গিয়েছে আবৃত্তি সংসদ। বন্ধ হয়ে গিয়েছে বইমেলা।
সাতের দশকের শুরুতে নাট্য আন্দোলনের পথ ধরে এই মহকুমা শহরে তৈরি হয়েছিল একের পর এক নাট্যগোষ্ঠী। এই নাট্যগোষ্ঠীগুলি নিজেরা যেমন নাটক করত তেমনই আয়োজন করত নাট্য প্রতিযোগিতারও। সাতের দশকের মাঝামাঝি থেকে নয়ের দশকের গোড়া পর্যন্ত ‘অন্বেষণ’ নিয়মিত প্রতি বছর আয়োজন করেছে নাটক প্রতিযোগিতার। এখন সে সব অতীত। এখনকার নাট্যচর্চা বলতে জানুয়ারি মাসের গোড়ায় কলকাতা থেকে দল এনে উলুবেড়িয়ার রবীন্দ্রভবনে আয়োজিত হয় নাট্য উৎসব। চলে তিন-চার দিন ধরে। উলুবেড়িয়ায় বড়মাপের নাট্যমেলা বলতে এটাই।
কেন এই হাল?
প্রবীর দত্ত, অনুপ চক্রবর্তী বললেন, ‘‘বিনোদনের একাধিক মাধ্যম এসে গিয়েছে। নতুন ছেলেমেয়ে আর নাটকে আসছে না।’’ অনিকেত-এর পক্ষে সুপ্রিয় ধর বলেন, ‘‘আমাদের গোষ্ঠীর সব সদস্যই প্রায় চাকরি সূত্রে বাইরে। ফলে দল ভেঙে গিয়েছে। পরবর্তীকালে আর জোড়া লাগানো যায়নি।’’ এখনও টিম টিম করে নিজেদের দল টিকিয়ে রাখতে পারলেও কতদিন তা পারবেন, নিজেরাই সংশয়ে প্রবীরবাবু,বা অনুপবাবুরা। প্রবীরবাবুর কথায়, ‘‘গত বছরের নাট্য উৎসবে আমরা নতুন নাটক নামাতে পেরেছিলাম। কিন্তু নতুন ছেলে-মেয়ে না পাওয়ায় এ বছর নাট্য উৎসবে নতুন নাটক নামাতে পারব বলে মনে হয় না।’’ তাঁর আক্ষেপ, “একটা সময়ে নাটকের দল ছিল। নাটক করার মঞ্চ ছিল না। অথচ যখন রবীন্দ্রভবন পেলাম, তখন দলই নেই।’’
চলছে মহড়া ( বাঁ-দিকে)। ‘উদ্দীপন’ গোষ্ঠীর নাটক ‘ডাক দিয়ে যাই’-এর একটি মূহূর্ত ( ডান দিকে)।
মহিলাদের নিজস্ব সাংস্কৃতিক সংগঠন ‘মুক্তধারা’ তৈরির নেপথ্যে ছিলেন যাঁরা, তাঁদেরই অন্যতম সোমা ধর বলেন, ‘‘অনুষ্ঠানের জন্য চাঁদা তোলা থেকে শুরু করে মঞ্চ ভাড়া করা, বিজ্ঞাপন সংগ্রহ কি না করেছি আমরা। কিন্তু ধীরে ধীরে সংগঠনের সবারই বিয়ে হয়ে গেল। পরবর্তীকালে নতুন মেয়ে পেলাম না। মনে হয় পরবর্তী প্রজন্মের উৎসাহের অভাবেই এই অবস্থা। তবে হাল ছেড়ে না দিয়ে, আমরা পুরনোরাই ফের নতুন করে নামার কথা ভাবছি।’’
উলুবেড়িয়ার সংস্কৃতির অঙ্গ ছিল যে বইমেলা তা-ও বছর চারেক হল বন্ধ হয়ে গিয়েছে। বইমেলার উদ্যোক্তাদের অন্যতম সুপ্রিয় ধরের আক্ষেপ, “কী ভাবে যেন সব বদলে গেল।” রবীন্দ্রভবন না থাকায় নাটক হত উলুবেড়িয়া কলেজের নিজস্ব হরিপদ মঞ্চে। খোলা আকাশের নীচে আগ্রহের সঙ্গে সেই সব নাটক দেখতেন নাট্যপ্রেমীরা।তবে থামেননি প্রবীরবাবু, অনুপবাবুরা। অনুপবাবুর কথায়, “নাটক ছাড়া বাঁচতে পারব না। নিজের লেখা নাটক নিয়েই ছেলেমেয়েদের ধরে এনে নাটক শেখাই। বছরে একবার দু’বার নাটক করাই রবীন্দ্রভবনে। টাকার জোগাড় করতে হয় অনেক কাঠখড় পুড়িয়ে। তবু থামতে চাই না।”
হয়তো এ ভাবেই ফের এগোবে উলুবেড়িয়ার নাট্যচর্চা। পুরনো ধারা থেকেই জন্ম নেবে এক নতুন সংস্কৃতি।
ছবি তুলেছেন সুব্রত জানা।