ধীরে: কম শ্রমিকে চলছে কাজ। ছবি: সঞ্জীব ঘোষ
পরিস্থিতি একটু বিগড়োলেই ওঁরা সিঁদুরে মেঘ দেখেন। তখন নতুন করে শুরু হয় টিকে থাকার লড়াই।
কখনও পরিকাঠামোর খামতি, কখনও জিএসটি, কখনও নোটবন্দি— বারবার নানা প্রতিবন্ধকতার মুখে পড়েছে হাওড়া-হুগলির বিস্তীর্ণ এলাকার তাঁতশিল্প। এ বার তাঁদের প্রতিদ্বন্দ্বী— ‘লকডাউন’।
আরামবাগের সরাইঘাটা গ্রামে মাকুর শব্দ উধাও! গ্রামের ১৩৫টি তন্তুবায় পরিবার বিপাকে পড়েছেন। প্রশান্ত চৌধুরী নামে এক তাঁতি বলেন, ‘‘মজুত সুতো লকডাউনের দিন দশেকের মধ্যেই শেষ। সাদা সুতো কিছু থাকলেও রং নেই। ফলে, শাড়ি তৈরি করা যাচ্ছে না। করেই বা কী হবে! মজুত শাড়িই বিক্রি হচ্ছে না। হলেও অনেক কম দামে।’’ অশোক দে এবং নিমাই দে নামে আরও দুই তাঁতি বলেন, ‘‘পেট চালাতে গয়না, ঘটি-বাটি বন্ধক দেওয়া শুরু হয়েছে। প্রশাসন আমাদের খোঁজই রাখছে না।’’ অমিয় দে নামে আর এক জনের কথায়, ‘‘সমস্যা নিয়েই আমরা টিকে রয়েছি। কিন্তু লকডাউনের জেরে কারবার পুরো বসে গিয়েছে।’’ আরামবাগ ব্লক শিল্প উন্নয়ন আধিকারিক প্রভাতকুমার ঘোষ জানান, তাঁতশিল্পীদের বিষয়টি বস্ত্র এবং শিল্প দফতরের গোচরে আনা হবে।
হুগলিতে কেউ সমবায়, কেউ মহাজনের কাছ থেকে মজুরির বিনিময়ে তাঁত বোনেন। নকশা অনুযায়ী ২০০ থেকে ৪০০ টাকা পর্যন্ত মজুরি। তাঁতিদের বক্তব্য, সপ্তাহে ৪ থেকে ৭টি শাড়ি বুনতে পারেন তাঁরা। পরিবারের অন্তত দু’জনকে হাত লাগাতে হয়। প্রসিদ্ধ ধনেখালি তাঁত দীর্ঘদিন ধরেই খুঁড়িয়ে চলছে। এখন পরিস্থিতি আরও খারাপ। সোমসপুর ইউনিয়ন কো-অপারেটিভ উইভার্স সোসাইটি লিমিটেড, ধনিয়াখালি ইউনিয়ন তাঁতশিল্পী সমবায় সমিতি লিমিটেড, গুড়াপ তন্তুবায় সমবায় সমিতি লিমিটেড— সর্বত্র দুশ্চিন্তা। এই সব সমবায়ের কর্তৃপক্ষ জানান, বাজার-হাট বন্ধ। কেউ শাড়ি নিচ্ছেন না। চৈত্র সেল মার খাওয়ায় প্রচুর শাড়ি জমে গিয়েছে। তা সত্ত্বেও তাঁতিতের দিকে তাকিয়ে শাড়ি তৈরি করানো হচ্ছে। কিন্তু সুতোর ভাঁড়ার কার্যত শেষ। রং-ও আসছে না। ফলে, কিছু দিনের মধ্যে পরিস্থিতি স্বাভাবিক না হলে কাজ বন্ধ হয়ে যাবে।
সোমসপুরের সমবায়টির ম্যানেজার বিনয়ভূষণ লাহা জানান, সুতো আসে কোয়ম্বত্তুর থেকে। লকডাউনে সুতো আসছে না। তাঁর কথায়, ‘‘ফাল্গুন মাস থেকেই দুর্গাপুজোর জন্য কাপড় বোনা শুরু হয়। কিন্তু এখন সেই পরিস্থিতি নেই। জমা সুতোয় অল্প কিছুদিন চলবে। কাঁচামাল না এলে তাঁতিদের আর কাজ দেওয়া যাবে না। প্রায় ১০ হাজার শাড়ি জমে গিয়েছে। সেগুলো বিক্রি না হলে কাপড় তৈরি করে রাখবই বা কোথায়?’’ কেদারনাথ ভড় নামে সোমসপুরের এক তাঁতি বলেন, ‘‘এমনিতেই দিন আনি দিন খাই। পরিস্থিতি না শুধরোলে সংসার চলবে না।’’ গুড়াপের সমবায়ের ম্যানেজার জামিনি গুঁই বলেন, ‘‘এখনই ২০ লক্ষ টাকার শাড়ি জমে। নতুন বরাত আসছে না। শীঘ্রই পরিস্থিতি শুধরোনোর অবস্থা দেখছি না।’’সঙ্কটে রাজবলহাটের তাঁতিরাও।
হাওড়ার উদয়নারায়ণপুর ব্লকের বহু তাঁতি গজা তন্তুবায় সমবায় সমিতির মাধ্যমে কাপড় বোনেন। রাজ্য খাদি বোর্ডের দেওয়া তুলো থেকে সুতো বুনে কাপড় তৈরি করেন তাঁতিরা। কাপড় খাদি বোর্ড কেনে। লকডাউনের জন্য তাঁরা সব কাজ বন্ধ করে দিয়েছেন। যে কাপড় তাঁরা কিনেছেন, লকডাউনের জন্য সেই দামও তাঁতিরা পাননি। তন্তুজ সমিতিকে ৫০০ শাড়ি এবং ধুতির বরাত দিয়েছে। সেগুলো তৈরি হয়ে গেলেও সমিতি তন্তুজকে দিতে পারেনি। সমিতির সম্পাদক সৌমেন মণ্ডল বলেন, ‘‘কয়েকশো তন্তুবায় পরিবার গভীর সঙ্কটে।’’
তথ্য সহায়তা: পীযূষ নন্দী