সান্ত্বনা: নিহতের বাড়িতে তৃণমূল নেতারা। —নিজস্ব চিত্র।
পিটিয়ে তাঁর বাঁ হাত এবং ডান পা ভেঙে দেওয়া হয়েছিল। সারা শরীরে ছিল কালশিটে। গ্রামেরই এক নেতার বাড়ির সামনে পড়ে তিনি গোঙাচ্ছিলেন। উদ্ধার করে তাঁকে বাড়ি পৌঁছে দেওয়া হয়। কিন্তু বাঁচানো যায়নি। সঙ্গে সঙ্গে হাসপাতালে নিয়ে যাওয়া হলে চিকিৎসকেরা তাঁকে মৃত ঘোষণা করেন।
সোমবার রাতে গোঘাটের দড়িনকুণ্ডা গ্রামের লালচাঁদ বাগ (৩১) নামে দিনমজুরের কাজ করা ওই তৃণমূল কর্মীকে কী কারণে পিটিয়ে খুন করা হল তা পুলিশের কাছে স্পষ্ট নয়। তাঁর পরিবারের অভিযোগ, এই খুনের পিছনে রয়েছে বিজেপি। একই অভিযোগ তৃণমূল নেতৃত্বেরও। বিজেপির পাল্টা দাবি, খুনের কারণ তৃণমূলের গোষ্ঠীদ্বন্দ্ব। একই দাবি সিপিএমেরও। দায়ের হওয়া অভিযোগের ভিত্তিতে পুলিশ লালচাঁদের ছয় পড়শিকে (প্রশান্ত বাগ, মনোজ বাগ, পিরু বাগ, সুকুমার বাগ, মোহন পাত্র এবং মোহন সিংহ) গ্রেফতার করেছে। ধৃতদের মধ্যে প্রশান্ত গোঘাট থানার সিভিক ভলান্টিয়ার। কিন্তু তাদের রাজনৈতিক পরিচয় নিয়ে ধোঁয়াশা কাটেনি। এই নিয়ে ভোটের ফল প্রকাশের পর থেকে আরামবাগ মহকুমায় তিন তৃণমূল কর্মী খুন হলেন।
পুলিশ জানিয়েছে, নিহত লালচাঁদের পরিবার মোট ২১ জনের নামে অভিযোগ দায়ের করেছে। ঘটনার কোনও প্রত্যক্ষদর্শী মেলেনি। লাঠি, বাঁশ বা ভারী কিছু দিয়ে লালচাঁদকে পেটানো হয় বলে তদন্তকারীদের অনুমান। হুগলি জেলা (গ্রামীণ) পুলিশ সুপার তথাগত বসু জানিয়েছেন, তদন্ত চলছে। বাকি অভিযুক্তদের খোঁজ চলছে।
পুলিশ ও স্থানীয় সূত্রের খবর, ২১ জুলাই ধর্মতলায় তৃণমূলের সমাবেশে গ্রামবাসীদের একাংশ গিয়েছিলেন। যাঁরা যাননি, পরে তাঁদের সঙ্গে এ নিয়ে ওই গ্রামবাসীদের বচসা হয়। লালচাঁদ ও তাঁর পরিবারের লোকেরাও তাতে জড়ান। তাঁরা সমাবেশে গিয়েছিলেন। প্রতিদিন রাতেই গ্রামে গল্পগুজব করতে বেরোতেন লালচাঁদ। রাত সাড়ে ১০টা নাগাদ বাড়ি ফিরতেন। সোমবারও সাইকেল নিয়ে বেরিয়েছিলেন। রাত সাড়ে ১০টা নাগাদ তাঁর পরিবারের লোকেরা লালচাঁদকে পেটানো হয়েছে বলে খবর পান।
মিঁয়াপাড়ায় তৃণমূল নেতা জামির আকতার জানান, রাত সাড়ে ১০টা নাগাদ বাড়ির সামনে গোঙানি শুনে তিনি দরজা খুলে দেখেন, লালচাঁদ উপুড় হয়ে পড়ে রয়েছেন। জল চাওয়ায় স্ত্রী লালচাঁদকে দু’বার জল খাওয়ান। তাঁরাই লালচাঁদের বাড়িতে খবর দেন। বাড়ি ফিরেও লালচাঁদ তাঁর কোলে মাথা রেখে হামলাকারীদের মধ্যে সাত জনের নাম বলেন বলে মা পারুলাদেবীর দাবি। তাঁর পরেই লালচাঁদ নেতিয়ে পড়েন।
পড়শিদের ধারণা, ২১ জুলাইয়ের সমাবেশে যাওয়া নিয়ে যাদের সঙ্গে বচসা হয়েছিল, তারাই সোমবার রাতে লালচাঁদের ফেরার সময়ে হামলা করে। তারা মাচায় বসে লালচাঁদের জন্যে অপেক্ষা করছিল। নিহতের বাবা অজিতবাবুর দাবি, ‘‘দু’দিন আগেও যে সব পড়শি তৃণমূল করত, তারাই বিজেপিতে গিয়ে আমার ছেলেটাকে পিটিয়ে মারল।’’ মঙ্গলবার সকালে নিহতের বাড়িতে যান তৃণমূলের হুগলি জেলা সভাপতি দিলীপ যাদব এবং স্থানীয় বিধায়ক মানস মজুমদার। দিলীপ বলেন, ‘‘দল লালচাঁদের পরিবারের পাশে আছে। ২১ জুলাইয়ের সভায় যাওয়ার জন্য পরিবারটিকে বিজেপি রবিবারই হুমকি দিয়েছিল। আইন অনুযায়ী ব্যবস্থা নেওয়া হবে।’’ অভিযোগ উড়িয়ে বিজেপির আরামবাগ সাংগঠনিক জেলা সভাপতি বিমান ঘোষের দাবি, ‘‘সিপিএম বা তৃণমূলের দুষ্কৃতীদের আমাদের দলে ঠাঁই নেই। তৃণমূলের গোষ্ঠীদ্বন্দ্বেই এই খুন।”
ধৃতদের কাউকে দলের বলে মানতে চাননি বিজেপি বা সিপিএম নেতৃত্ব। অভিযুক্তদের আত্মীয়দের দাবি, এখানে অধিকাংশ পরিবারই যখন যে দল ক্ষমতায় থাকে, সেই দলেরই কর্মী-সমর্থক হয়ে যায়। এখনও বিজেপি পুরো ক্ষমতায় নেই। তাই অধিকাংশ পরিবারই দোদুল্যমান অবস্থায় রয়েছে। ২১ জুলাইয়ের সভায় যাঁরা যাননি, তাঁদের বিজেপি এবং সিপিএম সমর্থক দেগে মিথ্যা অভিযোগ করা হচ্ছে।
ময়নাতদন্তের পরে মঙ্গলবার সন্ধ্যায় লালচাঁদের দেহ ফেরে গ্রামে। বকুলতলা এলাকায় দেহ রেখে দোষীদের শাস্তির দাবিতে অবরোধ করে তৃণমূল।