ভূতের গুজবে হরিপালে দম্পতির উপরে হামলা হল। অলঙ্করণ: তিয়াসা দাস।
চার মাসে তিনটি ঘটনা। তবু হুঁশ নেই প্রশাসন বা রাজনৈতিক দলগুলির।
ডাইনি অপবাদে কোনও পরিবারকে ঘরছাড়া হতে হয়েছে, কারও বাড়ি ভাঙা হয়েছে, ভূত রয়েছে সন্দেহে। বাদ যায়নি মারধর। এরপরেও হরিপালের আদিবাসী অধ্যুষিত গ্রামগুলিতে সচেতনতা বৃদ্ধিতে কোনও উদ্যোগ নেই। কুসংস্কার রোধে এখনও কোনও প্রচার হয়নি। না সরকারি মহলে, না রাজনৈতিক দলগুলির তরফে। আরও ক’টি ঘটনার পরে সকলের টনক নড়বে, এ প্রশ্ন উঠছে। আদিবাসীদের নিজস্ব সংগঠন, ‘মাঝি পারগানা মহল’-এর নেতারা মানছেন, ডাইনি প্রথা কুসংস্কার। কিন্তু তা রুখতে প্রশাসন কোনও ব্যবস্থা নিচ্ছে না বলে তাদের অভিযোগ।
আদিবাসীদের আর একটি সংগঠন, ‘ভারতীয় আদিবাসী একতা মঞ্চ’-এর পশ্চিমবঙ্গের আহ্বায়ক, হরিপালেরই বাসিন্দা লক্ষ্মীকান্ত হাঁসদা বলেন, ‘‘আদিবাসী সমাজ এখনও কুসংস্কারে আচ্ছন্ন। কুসংস্কারকে হাতিয়ার করে কিছু মানুষ নানা অসামাজিক কাজে লিপ্ত। নিজেদের স্বার্থসিদ্ধির জন্য অসহায় মানুষকে ডাইনি তকমা দিচ্ছে। তাদের উপর নানা ভাবে অত্যাচার, লুটপাট চালাচ্ছে। এতে শাসকদলের একাংশের প্রশ্রয়ও রয়েছে। পুলিশ প্রশাসন কিছুই করে না।’’
হরিপালের বিডিও তপন হালদার অবশ্য এখন আশ্বাস দিয়েছেন, ‘‘মাঝি পরগানার নেতাদের সঙ্গে কথা বলে আমরা প্রচারে নামব।’’ কিন্তু এতদিন তা হয়নি কেন? বিডিও-র দাবি, ‘‘আমরা চাইছি সাঁওতাল ভাষায় আদিবাসী এলাকায় প্রচার করতে। ভাষার একটা ব্যাপার রয়েছে।’’ হরিপাল ব্লক ‘মাঝি পারগানা’র প্রধান সোনাচাঁদ সোরেনের ক্ষোভ, ‘‘যাঁদের ডাইনি অপবাদ দেওয়া হচ্ছে, প্রশাসনের তরফে তাঁদের ঘরে ঢুকিয়ে দিয়ে দায় সারা হচ্ছে। কিন্তু যারা আদিবাসী সমাজে কুসংস্কার ছড়াচ্ছে, তাদের বিরুদ্ধে প্রশাসন ব্যবস্থা নিচ্ছে না। প্রশাসনের উচিত তাদের চিহ্নিত করে শাস্তির ব্যবস্থা করা।’’
চলতি বছরের অগস্ট মাসে হরিপালের সহদেব পঞ্চায়েতের রাধাকৃষ্ণ গ্রামে থ্যালাসেমিয়া আক্রান্ত একটি শিশুর পরিবারকে একঘরে করে দেওয়ার অভিযোগ উঠেছিল। গ্রামবাসীদের একাংশ সেই সময় অভিযোগ তোলেন, শিশুটির মা ‘ডাইনি’। তিনি শিশুটির রক্ত খাচ্ছে। তাই শিশুটির রক্ত কমে যাচ্ছে। শেষ পর্যন্ত পুলিশের হস্তক্ষেপে পরিবারটি ঘরে ফেরে।
এর কিছুদিন পর, ওই মাসেই হরিপালের বন্দিপুর গ্রামে এক পরিবারকে একই অপবাদে ঘরছাড়া করার অভিযোগ ওঠে গ্রামবাসীদের একাংশের বিরুদ্ধে। তিন মাস ঘরছাড়া থাকার পরে এ ক্ষেত্রেও পুলিশ পরিবারটিকে ঘরে ফেরানোর ব্যবস্থা করে। পরিবারটির অভিযোগ ছিল, গ্রামের কেউ মারা গেলে তাঁদের ‘ডাইন’ অপবাদ দেওয়া হতো।
ঘরে ফেরার পরে ওই দুই পরিবারের আর সমস্যা হয়নি। কিন্তু গত মঙ্গলবার ইলিপুরের আড্ডা গ্রামের এক দম্পতি আক্রান্ত হন। তাঁদের বাড়িতে ভূত রয়েছে, এই সন্দেহে সেখানে ভাঙচুরও চালানো হয়। দম্পতি বর্তমানে তারকেশ্বরে রয়েছেন। ফের আক্রান্ত হওয়ার ভয়ে তাঁরা ফিরতে পারছেন না। গ্রামবাসীদের একাংশও এখনও ‘ভূত-তত্ত্ব’ আঁকড়ে রয়েছেন।
বেসরকারি স্তরেও এ সব রোখার কোনও উদ্যোগ নেই কেন?
‘পশ্চিমবঙ্গ বিজ্ঞান মঞ্চ’-এর রাজ্য কমিটির সদস্য চন্দন দেবনাথ বলেন, ‘‘আমরা নিশ্চয়ই ওই সব গ্রামের মানুষকে বোঝাব। প্রশাসন সাহায্য করলে ওখানকার মানুষকে সঙ্ঘবদ্ধ করে প্রচার করব।’’ শাসকদলের তরফে ব্লক তৃণমূল সভাপতি তথা সহদেব পঞ্চায়েতের প্রধান দেবাশিস পাঠকও প্রচারের আশ্বাস দিয়েছেন।