ক্লাসরুমে প্রজেক্টরের মাধ্যমে চলছে পাঠদান। ছবি: দীপঙ্কর দে।
বছর দশেক আগে পর্যন্ত গ্রামে ঢুকলেই অগুন্তি চোলাইয়ের ঠেকে দেখা যেত ওদের।
তখন ওরা বড়দের সঙ্গে চোলাই বানাত। এখন ওরা বইয়ের জগতেই বেশি স্বচ্ছন্দ!
সিঙ্গুরের পলতাগড় রাধারানি শিক্ষামন্দির কয়েক বছরে আমুল বদলে দিয়েছে পলতাগড় গ্রামের কচিকাঁচাদের। আকর্ষণের কেন্দ্রবিন্দু স্কুলের নবম শ্রেণির ‘স্মার্ট-ক্লাস’। প্রজেক্টরের মাধ্যমে বইয়ের পাঠ, মাইক্রোফোনে স্যারদের গলা, পাবলিক অ্যাড্রেস সিস্টেমে বিধিনিষেধ ঘোষণা— প্রথম প্রথম চোখ ছানাবড়া হয়ে যেত পড়ুয়াদের। বেশির ভাগই প্রথম প্রজন্মের ছাত্রছাত্রী। তারাই এখন ‘স্মার্ট’ হচ্ছে। এর সঙ্গে রয়েছে স্কুলের নানা কর্মসূচি।
স্কুল কর্তৃপক্ষ বলছেন, এখন ছেলেমেয়েরা বুঝছে— স্টেশন পর্যন্ত চোলাইয়ের ড্রাম পৌঁছে দেওয়ার চেয়ে পরীক্ষায় ভাল নম্বর পাওয়া জরুরি। চোলাই বিক্রিতে বাবাকে সাহায্য করার চেয়ে বিকেলে ফুটবল খেললে আনন্দ বেশি। নেশাগ্রস্ত বাবার হাতে মায়ের মার খাওয়া বন্ধ করতে তাদের নিজের পায়ে দাঁড়াতে হবে। স্কুল কর্তৃপক্ষ চান, গ্রাম থেকে চোলাই বেচাকেনার পরম্পরা দূর করতে এগিয়ে আসুক এই নয়া প্রজন্ম। তাই আধুনিক প্রযুক্তি ব্যবহারে ছেলেমেয়েদের মানোন্নয়নের পথে এগিয়ে দেওয়ার চেষ্টা চলবে। চলতি বছরে ভূগোল এবং ভৌতবিজ্ঞানেরও ‘স্মার্ট ক্লাস’ চালু করা হবে।
কয়েক বছর আগে স্কুলটি উচ্চ মাধ্যমিক স্তরে উন্নীত হয়। ফলে, আগে মাধ্যমিকে কম নম্বর পাওয়া যে সব মেয়েদের পড়াশোনায় দাঁড়ি পড়ে যেত, এখন তারা স্কুলেই ভর্তি হচ্ছে। স্কুলের উচ্চ মাধ্যমিকের ফলাফলও ভাল হচ্ছে। ২০১৩ সালে একাদশ শ্রেণিতে যারা ভর্তি হয়েছিল, তাদের মধ্যে মাত্র দু’জন মাধ্যমিকে প্রথম বিভাগে পাশ করা ছাত্র ছিল। ২০১৫ সালে যখন এই পড়ুয়ারা উচ্চ মাধ্যমিক দেয়, তাদের মধ্যে ২৪ জন প্রথম বিভাগে উত্তীর্ণ হয়। গত বছর ২১ জন উচ্চ মাধ্যমিকে প্রথম বিভাগে পাশ করে।
স্কুলের বয়স ৬০ বছর পেরিয়েছে। পড়ুয়ার সংখ্যা এক হাজারের বেশি। শিক্ষক-শিক্ষিকা মিলিয়ে রয়েছেন ২৯ জন। বছর দশেক আগে স্কুলের প্রধান শিক্ষকের দায়িত্ব নেন দীপঙ্কর বন্দ্যোপাধ্যায়। তাঁর উদ্যোগেই বছর কয়েক আগে শিক্ষক-শিক্ষিকারা সিদ্ধান্ত নেন, আর্থ-সামাজিক দিক থেকে পিছিয়ে পড়া এই এলাকার মানোন্নয়ন করতে হলে পড়ুয়াদের গড়ে তুলতে হবে। এ জন্যই হাতিয়ার প্রযুক্তি। ধীরে ধীরে স্কুলে পড়ুয়ার সংখ্যা বাড়তে থাকে।
প্রধান শিক্ষক জানান, প্রতিটি বিষয়ে প্রত্যেক ছাত্রছাত্রীর মূল্যায়ন হয়। ওই পড়ুয়া পরবর্তী ক্লাসে উঠলে আগের মূল্যায়নের রেখচিত্র সংশ্লিষ্ট শিক্ষকের হাতে তুলে দেওয়া হয়। তিনি বলেন, ‘‘সার্বিক পরিস্থিতির উন্নতি হয়েছে। ছেলেমেয়েদের মধ্যে মূল্যবোধ বাড়ছে। ধীরে ধীরে সব ক্লাসকেই স্মার্ট-ক্লাস হিসেবে গড়ে তোলা হবে।’’ নবম শ্রেণির সুমন দাস, নীলাঞ্জনা কোলেরা বলছে, ‘‘প্রজেক্টরের মাধ্যমে বড় পর্দায় পড়ার বিষয় ভেসে ওঠায় বুঝতে সুবিধা হচ্ছে। গতানুগতিক ভাবে চলতে চাই না আমরা।’’
তবে, শুধু স্কুলের ঘেরাটোপেই আবদ্ধ থাকতে চান না কর্তৃপক্ষ। গ্রামের মানোন্নয়নে তাঁরা স্কুলের তরফে সামাজিক কাজেও যোগ দিচ্ছেন। স্কুলে পাঁচ কিলোওয়াটের সৌরবিদ্যুতের ব্যবস্থা করা হয়েছে। উদ্বৃত্ত বিদ্যুৎ রাজ্য বণ্টন সংস্থার গ্রিডে দিয়ে গ্রামবাসীদের ঘরে আলো জ্বালানো হচ্ছে। সম্প্রতি শ’দেড়েক বাড়িতে স্বাস্থ্যবিধান সংক্রান্ত পোস্টার লাগানো হয়েছে স্কুলের তরফে। প্রতি মাসে অভিভাবক-শিক্ষক বৈঠক চালু হচ্ছে। স্কুলের এই উদ্যোগে খুশি অভিভাবকেরাও। অরুণ দাস নামে এক অভিভাবক বলেন, ‘‘ছেলেমেয়েরা উন্নত মানের শিক্ষা পেলে তো আশপাশের এলাকার উন্নতি হবেই।’’ চম্পা দে নামে আর এক অভিভাবকের বক্তব্য, ‘‘স্কুল যা করছে, তাতে ছেলেমেয়েদের ভাল হবে। গ্রামেরও ভাল হবে।’’
স্কুলে সমস্যা কম নয়। মাঠ নেই। বাড়তি ঘর নেই। খাওয়ার জায়গা নেই। কিন্তু সে সব বাধা কাটিয়ে এগোতে চান কর্তৃপক্ষ। আর সেই ভাবনাই তাঁরা সঞ্চারিত করছেন পড়ুয়াদের মধ্যেও।