চিত্র ১: শনিবার রাত ১০টা। উত্তর হাওড়ার মুরগিহাটা মোড়ের কাছে অতুল্যকৃষ্ণ ঘোষ লেন। সামনেই ১৩১ নম্বর বুথ। একটি চায়ের দোকানে বসে গল্প করছিলেন চার-পাঁচ জন যুবক। আচমকাই ১০-১২ জনের একটি বাইকবাহিনী এসে সামনে দাঁড়াল। কথা বলার সুযোগ না দিয়েই শুরু হল মারধর। সঙ্গে শাসানিও— ‘ভোটের দিন এ তল্লাটে যেন না দেখি।’
চিত্র ২: মধ্য হাওড়ার ২৬ নম্বর ওয়ার্ডের দয়াল ব্যানার্জি লেন। রাস্তার ধারে দলীয় পতাকা লাগাচ্ছিলেন জোট-সমর্থক সিপিএম কর্মীরা। ১০-১২ জনের বাহিনী লাঠি-বাঁশ হাতে ঝাঁপিয়ে পড়ল। আহত হলেন শুভাশিস ঘোষ নামে এক কর্মী।
চিত্র ৩: দক্ষিণ হাওড়ার সত্যেন বোস রোড। শনিবার রাতে জোটের এজেন্ট সোমনাথ রায়ের বাড়িতে শাসিয়ে গেলেন তৃণমূলের লোক — ‘‘বুথে গিয়ে বসলে পাড়ায় থাকতে দেওয়া হবে না।’’
রাত পোহালেই ভোট। ঠিক ২৪ ঘণ্টার আগে এই চিত্রগুলিই বুঝিয়ে দেয় হাওড়া শহরে ভোট কেমন হতে চলেছে। অভিযোগ, পুলিশের তরফে পরিস্থিতিটা রাতারাতি পাল্টে দেওয়ার কোনও উদ্যোগ রবিবার দিনভর চোখে পড়েনি। উদ্যোগ দেখা যায়নি নির্বাচন কমিশনের পক্ষ থেকেও। এ দিন ঠা ঠা রোদ মাথায় নিয়ে কেন্দ্রীয় বাহিনীকে বড় রাস্তা বা অলিগলিতে রুট মার্চ করতে দেখা গেলেও মোটর বাইক আরোহীর হেলমেট পরীক্ষা ছাড়া তাদের তেমন কিছু করতে দেখা যায়নি। শনিবার সন্ধে থেকে প্রশাসনের ঘোষণা করা ১৪৪ নম্বর ধারায় যে কোনও লাভ হয়নি, বালি থেকে বট্যানিক্যাল গার্ডেন চক্কর কেটেই তা বোঝা গিয়েছে। ভোটের আগের দিনটা ছিল অন্য রবিবারের মতোই। বাজারে ভিড়, রাস্তার মোড়ে-মোড়ে জটলা, চায়ের দোকানে ভোট-চর্চার চেনা ছবিই বহাল ছিল। তার ভিতরেই চলেছে ভোট নিয়ে শাসক দলের তর্জন-গর্জনের অভিযোগ।
বিরোধীদের অভিযোগ, শাসকের এই দাপট শুরু হয়েছে শনিবার, ১৪৪ নম্বর ধারা জারির পর থেকে। প্রধান বিরোধী দল বাম গণতান্ত্রিক জোটের দায়িত্বপ্রাপ্ত দক্ষিণ হাওড়ার সিপিএম নেতা সমীর সাহা থেকে উত্তর হাওড়ার জোটপ্রার্থী কংগ্রেসের সন্তোষ পাঠক এবং বিজেপির জেলা সভাপতি দেবাঞ্জল চট্টোপাধ্যায়— সকলেরই দাবি, ভোটের দু’দিন আগে থেকে শহর জুড়ে এই শাসানি-মারধর নিয়ে পুলিশ বা নির্বাচন কমিশনে অভিযোগ জানিয়েও লাভ হয়নি। সমীর বাবু বলেন ,‘‘দক্ষিণ হাওড়ায় তৃণমূল রাত থেকেই লিচুবাগান, গোয়াবেড়িয়া, শালিমার, সত্যেন বোস রোড ইত্যাদি জায়গায় এজেন্টদের বাড়ি বাড়ি গিয়ে তৃণমূল শাসাচ্ছে, ভয় দেখাচ্ছে।’’ একই অভিযোগ জোটপ্রার্থী সন্তোষবাবুর। তিনি বলেন, ‘‘সুভাষ নন্দী নামে এক এজেন্টকে তাঁর বাড়িতে গিয়ে পরিবারের লোককে ভয় দেখিয়ে এসেছে তৃণমূল। বলেছে, বুথে গেলে গুলি করে দেবে।’’ সন্তোষবাবুর অভিযোগ, পুলিশকে এবং কমিশনকে জানিয়ে ফল হয়নি। রাতেই ফের ভয় দেখানো হয়েছে সুমন ঘোষ এবং চণ্ডী পাল নামে অন্য দুই এজেন্টকে।
জোটের অভিযোগ, সবথেকে বেশি শাসানি এবং ভোটারদের ভয় দেখানোর ঘটনা ঘটেছে উত্তর ও দক্ষিণ হাওড়ায়। উত্তর হাওড়ার ১, ২, ৩, ৫, ৬, ৭ নম্বর ওয়ার্ড-সহ ভোটবাগান, ব্যানার্জি বাগান, লালবিহারী বোস লেন, পালের বাগান ভোটারদের বাড়ি বাড়ি গিয়ে ভয় দেখানো হচ্ছে। অভিযোগ, নির্বাচন কমিশনের নির্দেশ থাকা সত্ত্বেও ভোটের আগের দিন শহরের বিভিন্ন ভোটকেন্দ্রের তৃণমূল কর্মীদের অবাধে যাতায়াত করতে দেখা গিয়েছে। অভিযোগ, সন্ধে থেকে ভোটকর্মীদের সঙ্গেই নানা বুথে ঢুকে পড়ছেন তৃণমূল কর্মী-সমর্থকেরা। সেখানেই চলছে খাওয়াদাওয়া। যেমন উত্তর হাওড়ার হিন্দু স্কুল, নীহার স্মৃতি প্রাথমিক বিদ্যায়, শিল্পাশ্রম ইত্যাদি বুথে কেন্দ্রীয় বাহিনীকে খাবার দিতে দেখা গিয়েছে বলেও অভিযোগ।
এ দিকে, ভোটের দিন হুগলি নদীতে ফেরি বন্ধ থাকলেও এ বার তা চালু থাকায় নতুন প্রশ্ন উঠে এসেছে। বিরোধীদের অভিযোগ, পরিকল্পনা মাফিক এই কাজ করা হয়েছে, যাতে কলকাতা বা অন্য জায়গা থেকে বহিরাগতদের সহজেই আনা যায়। হুগলি নদী জলপথ পরিবহণ সমবায় সমিতি লিমিটেড চেয়ারম্যান উত্তর হাওড়ায় বিদায়ী বিধায়ক অশোক ঘোষ বলেন, ‘‘ভোটের জন্য ফেরি সার্ভিস বন্ধ করতে পারি না। পরিবহণ সচিবের সঙ্গে কথা হয়েছে। তিনি খুলে রাখতে বলেছেন।’’ হাওড়ার জেলাশাসক শুভাঞ্জন দাস বলেন, ‘‘নদীপথে এ বার কেন্দ্রীয় বাহিনী পাহারা দিচ্ছে। ফলে বহিরাগতরা ঢুকলে প্রত্যেকের তল্লাশি চালানো হবে। ফলে সমস্যা হবে না।’’ বিরোধীদের অভিযোগের উত্তরে জেলা তৃণমূল সভাপতি (শহর) অরূপ রায় বলেন, ‘‘বিরোধীরা হারার আগেই হেরে বসে । তাই এ সব মিথ্যে অভিযোগ করছে। মারধর তো দূরের কথা, হুমকি দেওয়ার প্রশ্নই ওঠে না।’’
এই সব অভিযোগ আর পাল্টা অভিযোগের মাঝে এ দিন ভোটকর্মীরা বিকেল থেকে বিভিন্ন বুথে যেতে শুরু করেছেন। তাঁদের আসার আগেই পৌঁছে গিয়েছে কেন্দ্রীয় বাহিনীও।