নিয়মকে বুড়ো আঙুল দেখিয়ে এ ভাবেই চলে ছাই বহন। উলুবেড়িয়ার কাছে মুম্বই রোডে সুব্রত জানার তোলা ছবি।
উলুবেড়িয়ার কাছে ৬ নম্বর জাতীয় সড়কে মোটরবাইক চালাচ্ছিলেন অনির্বাণ ঘোষ। আচমকা চোখ কড়কড় করে উঠল। সঙ্গে প্রচণ্ড জ্বালা। কোনওমতে মোটরবাইক রাস্তার ধারে এনে দাঁড়িয়ে পড়লেন বছর তিরিশের ওই যুবক। চোখ কচলাতে কচলাতে দেখতে পেলেন দূরে চলে যাচ্ছে (ফ্লাই অ্যাশ) ছাই বোঝাই ডাম্পার। বুঝতে পারলেন, ওই ছাইয়ের গুঁড়ো উড়ে চোখে পড়াতেই এমন বিপত্তি।
মুম্বই রোডে যাতায়াতকারী অনেকেরই অভিজ্ঞতা অনির্বাণবাবুর মতোই। ছাই উড়িয়ে ডাম্পারের যাতায়াত নিত্যদিনের ঘটনা। ছাই বোঝাই করে চলেছে ডাম্পার। উটের পিঠের মতো উঁচু হয়ে রয়েছে ছাই। উঁচু হয়ে থাকা অংশ নেহাতই দায়সারা ভাবে এক ফালি প্লাস্টিকের চাদর দিয়ে ঢাকা। বাকি অংশ আঢাকাই পড়ে। হাওয়ার ধাক্কায় উন্মুক্ত অংশের ছাই উড়তে থাকে চারিদিকে। যা যানচালকদের চোখে পড়ে মাঝেমধ্যেই দুর্ঘটনার কারণ হয়ে দাঁড়ায়। পাশাপাশি বাড়ছে় দূষণও।
মুম্বই রোডে যাতায়াতকারী ছাই বোঝাই লরি থেকে দূষণের অভিযোগ অবশ্য নতুন নয়। ২০০২ সালের গোড়ায় হুগলির ডানকুনি থেকে খড়্গপুর পর্যন্ত মুম্বই রোডকে দুই থেকে চার লেনে করার কাজ শুরু হয়। প্রথমে ঠিক ছিল এই কাজে ফাঁকা জায়গা ভরাটের জন্য ব্যবহার করা হবে মাটি ও বালি। কিন্তু মাটি ও বালি পর্যাপ্ত পরিমাণে না মেলায় ঠিকাদার সংস্থা ঠিক করে কোলাঘাট তাপবিদ্যুৎকেন্দ্রের ছাই (ফ্লাই অ্যাশ) এই কাজে ব্যবহার করা হবে। এখন মুম্বই রোডকে ছয় লেনে পরিণত করা হচ্ছে। তাতেও ব্যবহার করা হচ্ছে হচ্ছে ছাই। এছাড়াও কারখানা বা বহু তল তৈরির জন্য নীচু জমি ভরাট করার কাজেও ছাই ব্যবহার করা হচ্ছে। ২০০২ সালেই ছাই দূষণের অভিযোগ ওঠে। বিভিন্ন স্বেচ্ছাসেবী সংস্থার তরফে দূষণ নিয়ন্ত্রণ পর্ষদের কাছে অভিযোগ জমা পড়ে। অভিযোগের প্রেক্ষিতে সেই সময়ে কেন্দ্রীয় দূষণ নিয়ন্ত্রণ পর্ষদ জানায়, ডাম্পারে ছাই নিয়ে যেতে হলে কিছু নিয়ম মেনে চলতে হবে। এক) ডাম্পারে তোলার পরে ছাই জল দিয়ে ভিজিয়ে দিতে হবে। দুই) ত্রিপল দিয়ে ছাই পুরো ঢেকে দিতে হবে। প্রথম প্রথম সেই নিয়ম মেনে চলা হলেও যত দিন গিয়েছে, ততই নিয়মের ফাঁস আলগা হয়েছে। দেখা গিয়েছে, দূষণ নিয়ন্ত্রণ পর্ষদের নির্দেশকে বুড়ো আঙুল দেখিয়ে প্রায় আঢাকা অবস্থাতেই ছাই নিয়ে যাতায়ত করছে ডাম্পারগুলি।
পাঁচলা মোড়ের কাছে একটি ক্লাবের কর্ণধার অজিত পাড়ুই বলেন, ‘‘ডাম্পারগুলি যে ভাবে ছাই নিয়ে যাতায়াত করে তাতে গাড়ির আরোহীদের চোখের ক্ষতি তো হচ্ছেই, এলাকার বাড়িঘরেও ছাইয়ের গুঁড়োর আস্তরণ পড়ছে। এতে রাস্তার ধারের বাড়িগুলি তো বটেই, এলাকাতেও দূষণ ছড়াচ্ছে। প্রশাসনের কোনও নজরদারি নেই।’’ তাঁর দাবি, পুলিশ ও প্রশাসনকে জানিয়েও কোনও কাজ হয়নি। খলিসানি কালীতলার বাসিন্দা তাপস কোদালির কথায়, ‘‘ছাইয়ের গুঁড়ো চোখে পড়ে অনেক যানচালক বিশেষ করে বাইক চালকেরা দুর্ঘটনায় পড়েন। এর প্রতিবাদে আমরা আন্দোলন করেছিলাম। কোনও কাজ হয়নি।’’
বিধি থাকা সত্ত্বেও তা না-মানার খেলা কেন?
ছাই ব্যবসায় যুক্ত মানুষজনের সঙ্গে কথা বলে জানা গিয়েছে, গলদ রয়েছে ছাই খাদানেই। কোলাঘাট তাপবিদ্যুৎকেন্দ্রে রয়েছে একাধিক ছাই খাদান। এখান থেকে ছাই নিয়ে যাওয়ার জন্য তাপবিদ্যুৎকেন্দ্র কর্তৃপক্ষ বিভিন্ন সংস্থাকে দায়িত্ব দিয়েছেন। সংস্থাগুলি দূষণের জন্য পরোক্ষে শ্রমিকদের দায়ী করে। খাদান মালিকদের বক্তব্য, ছাই তুলে তাঁরা নির্মাণ সংস্থাগুলিকে বিক্রি করেন। একময়ে ডাম্পারে ছাই ওঠানো-নামানোর কাজ করতেন শ্রমিকেরা। কিন্তু এখন যন্ত্রের সাহায্যে হওয়ায় শ্রমিক লাগে না। কিন্তু যন্ত্রের ব্যবহার শুরু হলেও খাদানগুলিতে থেকে গিয়েছেন শ্রমিকেরা। যে সংস্থাই খাদান থেকে ছাই খালি করার বরাত পাক না কেন, ওই শ্রমিকদের পারিশ্রমিক দিতেই হবে।
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক একটি সংস্থার কর্ণধারের কথায়, ‘‘আমরা যন্ত্র দিয়ে ডাম্পারে ছাই বোঝাই করি। ছাই খালি করার জন্যও কোনও শ্রমিকের প্রয়োজন হয় না। কিন্তু দু’জন শ্রমিকের মজুরি শ্রমিক সংগঠনগুলিকে দিতেই হয়।’’ সংস্থাগুলির বক্তব্য, ছাই বিক্রির সময় চারজন শ্রমিকের মজুরি ধরে দাম হিসাব করতে হয়। ফলে ছাইয়ের দাম বাড়ে। কিন্তু ক্রেতারা বাড়তি দাম দিতে রাজি হন না। তখন অতিরিক্ত ছাই ডাম্পারে বোঝাই করে তা ক্রেতাদের বিক্রি করতে হয়। ডাম্পারে নিয়ে যাওয়ার সময় ওই বাড়তি ছাই-ই উড়ে দূষণ ছড়ায়। অভিযোগ অস্বীকার করে তৃণমূল প্রভাবিত শ্রমিক সংগঠনের নেতা হাফিজুর রহমান বলেন, ‘‘তাপবিদ্যুৎকেন্দ্র কর্তৃপক্ষ খাদান থেকে ছাই তোলার জন্য খাদান মালিকদের একটা নির্দিষ্ট সময়সীমা বেঁধে দেয়। তার আগেই যদি ছাই তুলে ফেলা যায় তা হলে খাদান মালিকের লাভ অনেক বেশি। সেই কারণে নিয়মের বাইরে গিয়ে ডাম্পারে করে অনেক বেশি ছাই নিয়ে যান খাদান মালিকেরা। সেই ছাই উড়েই দূষণ হচ্ছে।’’
কী বলছে দূষণ নিয়ন্ত্রণ পর্ষদ?
রাজ্য দূষণ নিয়ন্ত্রণ পর্ষদের চেয়ারম্যান কল্যাণ রুদ্র বলেন, ‘‘তাপ বিদ্যুৎকেন্দ্রের ছাই থেকে যাতে দূষণ না ছড়ায় সেজন্য সুনির্দিষ্ট নিয়ম ও পদ্ধতি মেনে চলার বিধি রয়েছে।’’ কোলাঘাট তাপবিদ্যুৎকেন্দ্রের তরফে জানানো হয়েছে খাদানমালিক, ডাম্পার মালিক-সহ সংশ্লিষ্ট সব পক্ষের সঙ্গে নিয়মিত বৈঠক হয় দূষণবিধি মেনে চলার ব্যাপারে। হাওড়া গ্রামীণ জেলা পুলিশ সুপার বলেন, ‘‘এই বিষয়ে সুনির্দিষ্ট অভিযোগ পেলে আইনানুগ ব্যবস্থা নেওয়া হবে।’’