পদ্ম তুলছেন চাষি। উলুবেড়িয়ায় সুব্রত জানার তোলা ছবি।
এ যেন পদ্মের কাঁটা।
পুজোর মরসুমে বাড়তি রোজগারের স্বপ্ন দেখেছিলেন পদ্মচাষি গোপাল বাগ। কিন্তু আবহাওয়ার খামখেয়ালিপনা বাদ সেধেছে তাঁর স্বপ্নে।
কুলগাছিয়ায় রেলের খাত জমা নিয়ে পদ্ম চাষ করেন গোপালবাবু। ভোরবেলায় টিনের তৈরি এক চিলতে ডোঙায় বসে পদ্ম তোলার ফাঁকে নিজের হতাশার কথা শোনাচ্ছিলেন তিনি। গোপালবাবুর কথায়, ‘‘বিশ্বকর্মা পুজোর দিন পর্যন্ত পদ্ম তুলেছি দিনে ৪০০টি করে। আর এখন ৬০-৭০টা তুলতেও হিমশিম খাচ্ছি।’’
কেবল গোপালবাবু নন, একই অবস্থা অন্য পদ্মচাষিদেরও। উল্লেখ্য, হাওড়া জেলার বিস্তীর্ণ এলাকায় দক্ষিণ-পূর্ব রেলের হাওড়া-খড়্গপুর রেললাইনের ধারে নয়ানজুলিতে পদ্ম চাষ করা হয়। রেল কর্তৃপক্ষের কাছ থেকে জমি লিজ নিয়ে পদ্ম চাষ করেন চাষিরা। ফুল তোলা হয় বছরে তিন বার। মার্চ, জুন এবং সেপ্টেম্বর। এই মাস থেকেই আবার পুজোর মরসুম শুরু হয়ে যায়। চাষিরা লাভের গুড় ঘরে তোলার চেষ্টা করেন এই পর্যায়ের ফলন থেকেই। বিশেষ করে দুর্গাপুজোর দিনগুলিতে পদ্মের দারুণ চাহিদা নতুন কথা নয়। সব মিলিয়ে শুধু পুজোর চারদিনে শুধু পদ্মই লাগে কয়েক লক্ষ। সেই চাহিদার অনেকটা পূরণ করেন গোপালবাবুর মতো চাষিরা। যা পুজোয় তাঁদের বাড়তি রোজগার দেয়।
কিন্তু এবার কপালে ভাঁজ পদ্মচাষিদের। বিশ্বকর্মা পুজোর পরের দিন থেকেই আচমকা পদ্মর ফলন কমেছে। অন্য বছর এতটা খারাপ পরিস্থিতি ছিল না বলে চাষিরা জানিয়েছেন।
কেন এই হাল?
চাষিদের বক্তব্য, শিশির পড়লে পদ্ম ফলন কম হয়। অন্যবারের চেয়ে এ বছর বেশ কিছুটা আগেই শিশির পড়া শুরু হয়েছে। তার উপর বাড়তি বিপদ বৃষ্টি। রাতে বৃষ্টি হলে গাছের ক্ষতি হয় না। কিন্তু দিনের বেলায় বৃষ্টি হলে বা আকাশ মেঘে ঢাকা থাকলে পদ্মের ফলন কমে। এ বছর ঠিক সেটাই ঘটেছে। প্রায় প্রতিদিনই দিনের বেলায় বৃষ্টি হচ্ছে, আকাশ মেঘাচ্ছন্ন থাকছে। ফলে মার খাচ্ছে পদ্মের ফলন।
আর এই কম ফলনের প্রভাব পড়ছে পদ্মের দামেও। অন্য বছর যেখানে এই সময় দাম ছিল পদ্ম প্রতি ২ টাকা। এ বার এখনই দাম উঠে গিয়েছে প্রতিটি ৮ টাকা করে। যদিও এই দাম বৃদ্ধির সুফল চাষিরা পাচ্ছেন না। তাঁরা জানান, কম ফলনের গন্ধ পেয়েছে ফড়েরা। তারাই চাষিদের কাছ থেকে পদ্ম কিনে মজুত করতে শুরু করেছে। নিজস্ব খরচে তারাই হিমঘরে সেই পদ্ম রাখছে। পুজোর সময়ে চড়া দামে তা বাজারে বিক্রি করবে। চাষিরা থেকে যাচ্ছেন সেই তিমিরেই।
গোপালবাবু বলেন, ‘‘এর চেয়ে বরং ফলন বেশি হলেই আমাদের লাভ।’’ তিনি জানান, একটি পদ্ম ৮ টাকা করে বিক্রি হলে ৬০টি পদ্মের জন্য তিনি দাম পাচ্ছেন ৪৮০ টাকা। অন্যদিকে দিনে যদি ৪০০ করে পদ্ম ওঠে, তা হলে তা ২ টাকা প্রতিটি দরে বিক্রি হলেও তিনি দাম পাচ্ছেন ৮০০ টাকা। তাঁর কথায়, ‘‘আমরা চাই বেশি পদ্ম ফুটুক। তা হলে একদিকে যেমন ফড়েরা সুযোগ নিতে পারবে না। অন্যদিকে চাষিরাও বাড়তি পয়সা হাতে পাবেন।’’
সারা বাংলা ফুলচাষি ও ফুল ব্যবসায়ী সমিতির রাজ্য সম্পাদক নারায়ণ নায়েক বলেন, ‘‘কম ফুল হলে তার সুযোগ যাতে ফড়েরা নিতে না পারেন তার জন্য সরকারের উচিত হিমঘর করে দেওয়া। সেখানে চাষিরা নিজেরাই পদ্ম রাখতে পারলে পুজোর সময়ে দাম বৃদ্ধির সুযোগ পেতে পারেন। কিন্তু তা না থাকায় এখন তাঁরা ফড়েদের কাছে সব পদ্ম বিক্রি করে দিতে বাধ্য হচ্ছেন।’’
প্রসঙ্গত, বাগনানে একটি ফুলের বাজার এবং হিমঘর তৈরি করেছে রাজ্য সরকার। কিন্তু বছর তিনেক আগে তৈরি এই হিমঘর ও বাজার এখনও চালুই হয়নি। নারায়ণবাবু বলেন, ‘‘ওই হিমঘর চালু হলে শুধু হাওড়াই নয়, পূর্ব ও পশ্চিম মেদিনীপুরের ফুল চাষিরাও এখানে ফুল রাখতে পারতেন। ফড়েদের দৌরাত্ম্যও কমত।’’
রাজ্য কৃষি বিপণন দফতরের এক কর্তা জানান, বাগনান স্টেশন থেকে বাজার পর্যন্ত যাতায়াতের রাস্তা তৈরি করার পরিকল্পনা চলছে। রাস্তা তৈরি হয়ে গেলেই ওই বাজার ও হিমঘর চালু হয়ে যাবে।
তবে যতদিন তা না হচ্ছে, ততদিন পদ্মের কাঁটার খোঁচা থেকে রেহাই মিলছে না গোপালবাবুর মতো পদ্মচাষিদের।