জমির অনেকাংশে এখনও পড়ে ইটের টুকরো। ছবি: দীপঙ্কর দে
আলুর মরসুম কার্যত বেকার গিয়েছে। ধান চাষের সময় চলে এসেছে। কিন্তু জঙ্গলে ঢাকা সিঙ্গুরের সেই জমিতে কী ভাবে চাষ হবে, ফের একবার এই প্রশ্ন মাথাচাড়া দিল।
সিঙ্গুরের জমি-আন্দোলনের অন্যতম মুখ, বেড়াবেড়ি পঞ্চায়েতের শাসকদলের উপপ্রধান দুধকুমার ধাড়াই এখনও নিজের জমি চিনে উঠতে পারেননি। তাঁর কথায়, ‘‘আমি নিজেই আমার জমি চিনতে পারছি না। চাষ করব কী করে?’’ খাসেরভেড়ির মধুসূদন বারুইয়ের তিন বিঘা জমি রয়েছে। তাঁরও ক্ষোভ, ‘‘দু’টো মরসুম বেকার বসে থাকা যায়? জমি রয়েছে কিন্তু চাষ করতে পারছি না। জমি যে জঙ্গলে ঢাকা।’’
টাটা গোষ্ঠীর গাড়ি কারখানার জন্য বাম সরকার সিঙ্গুরের ৯৯৭ একর জমি অধিগ্রহণ করেছিল ২০০৬ সালে। সেই জমির অধিকার ফিরে পাওয়ার জন্য তারপরে দীর্ঘদিন জীবনপণ লড়াই করেছিলেন চাষিরা। অনেককে হাজতবাসও করতে হয়েছিল। ২০১৬-র ৩১ অগস্ট সুপ্রিম কোর্টের নির্দেশের পরে সেই জমি ফিরে পান চাষিরা। রাজ্য সরকার ওই জমিকে ‘চাষযোগ্য’ করতে তৎপরতাও দেখিয়েছিল। মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় নিজে সর্ষেবীজ ছড়িয়ে চাষের সূচনা করেছিলেন। কিন্তু চাষে জোয়ার এল কোথায়? ওই জমি নিয়েই চোখে সর্ষে ফুল দেখছেন সিঙ্গুরের চাষিরা।
জমি এখনও পুরোপুরি চাষযোগ্য হয়নি বলেই অভিযোগ বহু চাষির। ইতিমধ্যে এ নিয়ে জনস্বার্থ মামলাও হয়েছে সুপ্রিম কোর্টে। বর্তমানে ওই জমির অনেকটাই ঢেকেছে উলুখাগড়ার বনে।
গত বর্ষায় মাটি ধুয়ে গিয়ে বেরিয়ে এসেছে কারখানার কংক্রিটের চাদর। ফলে, বেশির ভাগ জমিতেই চাষিরা নামেননি। তাঁদের অভিযোগ, বহু জমি এখনও অসমান। ওই জমিতে গত বর্ষায় কোমরসমান জল জমে গিয়েছিল। এখন জল নেমে গেলেও জমির সীমানা নির্ধারণের কাজ হয়নি। প্রশাসন প্রথমে রিবন দিয়ে জমি চিহ্নিত করে দিলেও এখন তার কোনও অস্তিত্ব নেই। নেই আলও। ফলে নিজেদের জমি চিনতে পারছেন না চাষিরা। চাষ হচ্ছে বিচ্ছিন্ন কিছু অংশে।
দুধকুমারেরই আফসোস, ‘‘এই জমিকে চাষযোগ্য করতে ৭০ শতাংশ কাজ হল। কিন্তু ৩০ শতাংশ বকেয়াই রয়ে গেল এখনও। সে জন্যই জমি চাষিদের কাজে লাগছে না। প্রশাসনকে একাধিকবার জানিয়েও লাভ হয়নি।’’ সিঙ্গুরে সিপিএমের কৃষকসভার নেতা পাঁচকড়ি দাস বলেন, ‘‘মুখ্যমন্ত্রীর জেদ আর বাস্তব-বুদ্ধিহীনতাতেই সিঙ্গুরের জমির এই হাল। এখানে না হল শিল্প, না কৃষি। ওখানে চাষ সম্ভব নয়। মাঝখান থেকে সরকারি অর্থ অপচয় হল।’’
জেলা প্রশাসন অবশ্য দাবি করেছে, ওই জমি চিনে নেওয়ার জন্য চাষিদেরই গরজ নেই। জেলা প্রশাসনের এক কর্তা বলেন, ‘‘চাষিরা একযোগে ফের আবেদন করলেই প্রশাসন ওখানে গিয়ে তাঁদের জমি নির্দিষ্ট করার কাজে সহায়তা করবে। কিন্তু ওঁদের চাষে নামার ক্ষেত্রে কোনও ধারাবাহিকতা নেই। ফলে, বন-জঙ্গল হচ্ছে। আমাদের উদ্যোগ নষ্ট হচ্ছে।’’
চাষিরা দুষছেন প্রশাসনকে। প্রশাসন দুষছে চাষিকে। এই টানাপড়েনের মধ্যে এগিয়ে আসছে পঞ্চায়েত ভোট। অতীতের মতো ভোটের ফলে ওই জমি ফের নির্ণায়ক হয় কিনা, তা সময়ই বলবে।