নবরূপে: গ্রন্থাগারের নতুন ভবন। নিজস্ব চিত্র
ঘণ্টাখানেকের মধ্যে পুড়ে ছাই হয়ে গিয়েছিল বিদ্যাসাগর, রবীন্দ্রনাথ, নজরুল, সুকান্তের প্রায় ছ’হাজার বই। পুড়েছিল মনীষীদের ছবিও। ২২ বছর আগে খানাকুলের বলপাই গ্রামীণ পাঠাগারে অগ্নিসংযোগের ঘটনায় নিন্দার ঝড় উঠেছিল। কিন্তু সেই ঘটনায় কারা দায়ী তা আর জানা গেল না। অভিযুক্ত তৎকালীন তৃণমূল-বিজেপি জোটের ৬১ জনই বেকসুর খালাস পেয়ে গেলেন মঙ্গলবার।
ওই মামলায় মোট অভিযুক্ত ছিলেন ওই জোটের ৭৩ জন নেতাকর্মী এবং সমর্থক। তাঁদের মধ্যে জীবিত রয়েছেন ৬১ জন। মঙ্গলবার তাঁদের নির্দোষ বলে ঘোষণা করেন আরামবাগ আদালতের অতিরিক্ত দ্বিতীয় জেলা দায়রা বিচারক সুরথেশ্বর মণ্ডল। অভিযুক্তদের আইনজীবী তপন হাজরা জানান, সাক্ষ্যপ্রমাণের অভাবে তাঁর ৬১ জন মক্কেলই খালাস পেয়েছেন।
মূল অভিযুক্তদের মধ্যে ছিলেন বর্ষীয়ান তৃণমূল নেতা পান্নালাল সামন্ত। এ দিন মামলাটির নিষ্পত্তি হওয়ার পরে তিনি বলেন, ‘‘সেই সময় সিপিএমের লাইব্রেরি পরিচালন কমিটি আমাদের জোটের লোকদের বিরুদ্ধে মিথ্যা অভিযোগ করেছিল। সেই মামলার হয়রানি পোহাতে হচ্ছিল দীর্ঘদিন ধরে। অবশেষে নির্দোষ প্রমাণিত হয়েছি।” প্রৌঢ় বিজেপি নেতা তরুণ সাহাও বলেন, ‘‘মামলাটি যে মিথ্যা ছিল, তা প্রমাণিত হল। নিরপরাধীরা কেউ সাজা পেলেন না। আমরা খুশি।’’
পক্ষান্তরে, ওই এলাকার অশীতিপর সিপিএম নেতা গৌর জানার দাবি, ‘‘এলাকা দখলে নেওয়ার জন্য তৃণমূল-বিজেপি জোটের ওই হামলা প্রকাশ্যে হয়েছিল। মানুষ চাপে বা ভয়ভীতির জন্য যথাযথ সাক্ষ্য দেননি। সত্যটা স্থানীয় মানুষ জানেন। তা বদলাবে না।”
নতিবপুর-২ পঞ্চায়েত এলাকার ওই পাঠাগার পোড়ানো হয়েছিল ১৯৯৮ সালের ৩১ অক্টোবর সন্ধ্যায়। পাঠাগারের প্রতিষ্ঠাতা-সম্পাদক বছর পঁচাত্তরের বিশ্বনাথ জানা এ দিন রায় জানার পরে বলেন, ‘‘সাক্ষ্যপ্রমাণ না-পাওয়াতে খালাস হয়েছেন অভিযুক্তেরা। কিছু বলার নেই। কিন্তু সেই কালো দিনটার কথা ভোলা যায় না।’’
কী হয়েছিল সে দিন?
স্থানীয় সূত্রে জানা গিয়েছে, সেই সময় খানাকুলের দু’টি পঞ্চায়েত সমিতিই ছিল তৃণমূল-বিজেপি জোটের হাতে। নতিবপুর ২-সহ কয়েকটি পঞ্চায়েতে সিপিএম জিতে বোর্ড গঠন করেছিল। এই অঞ্চলে সিপিএমের মূল দলীয় কার্যালয়টি ছিল বলপাই লাইব্রেরির গায়েই। ঘটনার দিন সন্ধে সাড়ে ৭টা নাগাদ বোমা, বন্দুক, হাত-কামান, লাঠিসোটা নিয়ে বেশ কিছু যুবক প্রথমে গ্রামে এবং পরে লাইব্রেরি সংলগ্ন বাজারে হামলা করে। বাজারে অধিকাংশ দোকানেই ছিল খড়ের চালের ছাউনি। সেই সব ছাউনিতে আগুন লাগানো হয়। দোকান লুটপাট করা হয়। সেই তাণ্ডব দেখে বহু গ্রামবাসী এলাকা ফাঁকা করে পালাতে থাকেন। সব শেষে পাঠাগারে অগ্নিসংযোগ করা হয়। পরে দমকল এবং গ্রামবাসীদের একাংশ গিয়ে আগুন নেভান। ততক্ষণে অবশ্য পাঠাগারটি সম্পূর্ণ ভস্মীভূত হয়ে যায়।
পাঠাগার কর্তৃপক্ষ যে ৭৬ জনের বিরুদ্ধে থানায় অভিযোগ দায়ের করেছিলেন, তাঁরা সকলেই সে সময়ে তৃণমূল-বিজেপি জোটের নেতাকর্মী ও সমর্থক ছিলেন। মূল অভিযু্ক্তদের মধ্যে স্থানীয় তৃণমূল নেতা পান্নালাল সামন্ত-সহ অনেকেই গ্রেফতার করা হয়েছিল। পরে তাঁরা জামিন পান।
নতিবপুর অঞ্চলের বাসিন্দাদের আর্থিক সহায়তায় বলপাই খেলার মাঠের উত্তর-পশ্চিম দিক ঘেঁষে গ্রামীণ পাঠাগারটি প্রতিষ্ঠা হয়েছিল ১৯৬৯ সালে। অগ্নিসংযোগের ওই ঘটনার পরে ২০০১ সালে তৎকালীন মুখ্যমন্ত্রী বুদ্ধদেব ভট্টাচার্যের বিশেষ উদ্যোগে নতুন করে পাঠাগার ভবন তৈরি করা হয়। বলপাই এবং দৌলতচক গ্রামের বাসিন্দারা চাঁদা দেন। দুই গ্রামের নামেই গড়ে ওঠে নতুন পাঠাগার।