ফাইল চিত্র
পেঁয়াজ যে অর্থকরী ফসল, তা বুঝেছেন হুগলির বলাগড়ের চাষিরা। বুঝেছেন বাঁকুড়া-সহ রাজ্যের অন্যান্য এলাকার কিছু চাষিও। তা সত্ত্বেও এ রাজ্যে বিকল্প চাষ হিসেবে পেঁয়াজ এখনও সেই জনপ্রিয়তা পায়নি। অথচ, উদ্যানপালন দফতরের পক্ষ থেকে প্রচারের খামতি নেই। পেঁয়াজের বর্তমান অগ্নিমূল্যের কারণে সেই প্রশ্ন আবার ফিরে এসেছে, কেন ওই চাষে উদ্বুদ্ধ হচ্ছেন না চাষি?
কৃষি বিশেষজ্ঞেরা মনে করছেন, ধান এবং আলু—এই দুই প্রথাগত চেনা চাষের চৌহদ্দির বাইরে যাওয়ার মানসিকতা তৈরি হয়নি এ রাজ্যের চাষিদের। অথচ, এ রাজ্যের আবহাওয়া উপযোগী নির্দিষ্ট প্রজাতির পেঁয়াজ রয়েছে। যা মানের দিক থেকে ভিন্ রাজ্যের পেঁয়াজকে টেক্কা দিতে পারে। সুখসাগর প্রজাতির পেঁয়াজ চাষ হয় হুগলিতে বলাগড় ব্লক এবং পূর্ব বর্ধমানের কালনা মহকুমায়। যে চাষ জনপ্রিয় হলে রাজ্যে পেঁয়াজের হাহাকার অনেকটাই রুখে দেওয়া যেত বলে কৃষি বিশেষজ্ঞেরা মনে করেন। কিন্তু তা না-হওয়ায় ভিন্ রাজ্যের পেঁয়াজ আমদানির উপরেই নির্ভর করতে হয় পশ্চিমবঙ্গকে। কোনও কারণে পেঁয়াজ সরবরাহকারী রাজ্য থেকে জোগানে টান পড়লে এ রাজ্যের মানুষের মাথায় হাত। যা এ বার হয়েছে। সে কারণেই কৃষি বিশেষজ্ঞরা চাইছেন, চাষিদের মানসিকতার পরিবর্তন।
কল্যাণী কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ের বিশেষজ্ঞ দীপক ঘোষ বলেন, ‘‘চাষিদের যদি যথাযথ প্রশিক্ষণ দেওয়া যায়, তা হলে পেঁয়াজ চাষে ভাল ফল মিলবে। রাজ্যে পেঁয়াজের অভাব অনেকটাই কমবে। আর চাষি ভাল দাম পেলে উৎসাহীও হবে এই চাষে। তবে প্রচলিত চাষের আওতা থেকে চাষিদের বেরনোর মানসিকতাটা জরুরি।’’
মূলত বালি মিশ্রিত মাটি পেঁয়াজ চাষের পক্ষে আদর্শ। অক্টোবর-নভেম্বরে চাষের পর মার্চ-এপ্রিলে ফসল তোলা হয়। এ ছাড়াও বর্ষাকালীন পেঁয়াজ চাষ জনপ্রিয় করতে কয়েক বছর ধরেই চাষিদের উৎসাহিত করছে উদ্যানপালন দফতর। তাতেও অবশ্য বিশেষ লাভ হয়নি।
অথচ, বর্ষাকালীন পেঁয়াজ চাষ করে লাভের মুখ দেখেছেন বাঁকুড়া জেলার সেগুনসরা গ্রামের চাষি অভিষেক চৌধুরী। গত বর্ষার মরসুমে অন্তত ৩ বিঘে জমিতে তিনি পেঁয়াজ চাষ করেছিলেন। এখন ফসল উঠতে শুরু করেছে। তাঁর কথায়, ‘‘কল্যাণী কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ের তত্ত্বাবধানে আমরা চাষ করেছিলাম। বাজারে পেঁয়াজের দামও ভাল পাচ্ছি। আগামী বছর চাষের জমির পরিমাণ বাড়াব। একই সঙ্গে আমরা সুখসাগর প্রজাতির পেঁয়াজ চাষও বেশি পরিমাণ জমিতে করব বলে সিদ্ধান্ত নিয়েছি।’’
হুগলি জেলা উদ্যানপালন দফতর সূত্রে জানা গিয়েছে, এখানে বর্ষাকালীন পেঁয়াজ চাষের প্রবর্তন হয়েছিল ২০১২ সালে। সেই সময় বলাগড়, পোলবা এবং চুঁচুড়া-মগরা ব্লকে মাত্র বিঘা ১৫ জমিতে চাষ হয়েছিল। তাতে সাফল্য মেলায় পরের বছর চাষ শুরু হয় আরামবাগ, গোঘাট, তারকেশ্বর, হরিপাল, এবং ধনেখালি ব্লক এলাকাতেও। একলপ্তে চাষের এলাকা বেড়ে হয় প্রায় ১১০ হেক্টর। সে সময় ২০ জন চাষিকে প্রশিক্ষণের জন্য নাসিকেও পাঠানো হয়। এরপর ২০১৬ সাল অব্দি চাষের এলাকা না-বাড়লেও বর্ষাকালীন পেঁয়াজ চাষ হয়েছে। কিন্তু ২০১৭ সাল থেকেই রাষ্ট্রীয় কৃষি বিকাশ যোজনার অন্তর্গত ওই প্রকল্পটি মুখ থুবড়ে পড়ে।কেন?
আরামবাগের বলরামপুরের চাষি বাণেশ্বর চিনারের ক্ষোভ, ‘‘সংরক্ষণ ব্যবস্থা না থাকাই পেঁয়াজ চাষ বন্ধের অন্যতম কারণ। পচে যাওয়ার ভয়ে চাষিদের অভাবী বিক্রি করে দিতে হচ্ছিল। অন্যদিকে আবার ওই চাষ করতে গিয়ে মূল ফসল আমন ধানের এলাকাও কমে যাচ্ছিল। তা ছাড়া, ভাল প্রজাতির বীজ পাওয়া নিয়েও সংশয় ছিল। তবে, বর্তমান অবস্থার কথা ভেবে আবার বর্ষাকালীন পেঁয়াজ চাষ নিয়ে ভাবনাচিন্তা করছি। উদ্যানপালন দফতরকে ভাল জাতের বীজ নিশ্চিত করতে হবে।”
পেঁয়াজ সংরক্ষণের ‘স্টোর’ তৈরি খুব খরচসাপেক্ষ নয়। আলুর হিমঘরের মতো বড় অঙ্কের বিনিয়োগ এতে করতে হয় না। তা ছাড়া, ‘স্টোর’ বানাতে সরকার ভর্তুকি দেয়। চাষি নিজের ঘরেই তা তৈরি করতে পারেন বলে দাবি উদ্যানপালন দফতরের কর্তাদের। তাঁরা ফের হুগলির চাষিদের বর্ষাকালীন পেঁয়াজ চাষে উদ্বুদ্ধ করার সিদ্ধান্ত নিয়েছেন। এ জন্য ব্লক ধরে চাষিদের প্রশিক্ষণ এবং প্রচারের প্রক্রিয়া চলছে।
জেলা উদ্যানপালন আধিকারিক মৌটুসি মিত্র ধর বলেন, “বিশেষ সাড়া না মিললেও বর্ষায় পেঁয়াজ চাষেও চাষিদের উৎসাহিত করা হচ্ছে। সরাকারি সুযোগ-সুবিধাও মিলবে। পতিত উঁচু জমি ব্যবহার করে বর্ষাকালীন ওই চাষে পেঁয়াজের উৎপাদন বৃদ্ধির পাশাপাশি অর্থনৈতিক ভাবেও চাষিরা নতুন দিশা পাবেন।’’
লাভজনক ওই চাষে চাষিরা আবার উৎসাহিত হন কিনা, এখন সেটাই দেখার।