শহরের নিকাশির বর্তমান চেহারা। ছবি: তাপস ঘোষ।
গরমে জলের অভাবে চাতক পুরবাসী। আবা বর্ষা নামলে নিকাশির অভাবে সেই জলেই বন্দি তাঁরা। বস্তুত দেড়শো বছরের প্রাচীন হুগলি-চুঁচুড়া পুরসভায় জলযন্ত্রণার এটাই পরিচিত ছবি।
পুর পরিষেবা নিয়ে পুরবাসীর অভিযোগের তালিকায় নিকাশির অব্যবস্থা এখনও সবার উপরে। যদিও পুর এলাকার প্রবীণ বাসিন্দাদের দাবি, নিকাশির এ হেন বেহাল চিত্র অতীতে তাঁরা দেখেননি। ইতিহাসের পাতা বেয়ে যদি ডাচদের আমলে ফিরে যাওয়া যায় তা হলে কিন্তু নিকাশি নিয়ে বর্তমান অবস্থার উল্টো ছবিটাই ধরা পড়ে এই এলাকায়। শহরে পরিকল্পিত নিকাশির জন্য গঙ্গাপাড়ের এই প্রাচীন শহরে ডাচরা বিশেষ ব্যবস্থা করেছিল। সেই আমলে শহরে মাটির নীচ দিয়ে গড় তৈরি করা হয়েছিল। সেই গড় বেয়েই নিকাশি সমস্ত জল নেমে যেত। জল জমার সমস্যা ছিল না তখন। শহরের যে অঞ্চলে বসবাস ছিল, গড় সেই এলাকার মধ্য দিয়েই গিয়েছে। এখনও শহরে মাটির নীচে খিলান-সহ গড়ের অস্তিত্ব মালুম পাওয়া যায়। রাস্তাঘাট বা অন্য কোনও কারণে মাটি খুঁড়লে প্রাচীন ওই নিকাশি ব্যবস্থা কেমন সুচারুভাবে গড়ে তোলা হয়েছিল তা টের পাওয়া যায়। তাই বর্তমানে বেহাল নিকাশিতে বিপর্যস্ত শহরবাসীর অনেকেরই অভিমত, নিকাশি নিয়ে পুরসভাকে নতুন করে কিছু করতে হবে না। শুধু ডাচ আমলে যে ব্যবস্থাটা ছিল সেটাকেই যথাযথভাবে রক্ষা করে চালু রাখলে শহরে নিকাশি সমস্যার সমাধান হয়ে যাবে।
কিন্তু দীর্ঘ বাম শাসনে বা এখনকার শাসকদল কেউই ওই পথে হাঁটেননি। ফলে দশকের পর দশক অব্যবহৃত অবস্থায় পড়ে থেকে তার হাল ঠিক কেমন অবস্থায় আছে, উঠেছে সেই প্রশ্ন। তবে মহসিন কলেজে গঙ্গা লাগোয়া এলাকায় বা ২১ নম্বর ওয়ার্ডে দত্ত লজ লাগোয়া জায়গায় ডাচ আমলের নিকাশির অস্বিত্ব আজও টের পাওয়া যায়। সেই আমলে তৈরি গড়ের জল গঙ্গায় নামত।
ডাচ আমলের নিকাশি ব্যবস্থায় ফিরে না গেলেও বর্তমান পুর কর্তৃপক্ষের নেওয়া ব্যবস্থার সুফল কিন্তু এখনও শহরে অধরা।ফলে প্রতি বর্ষায় নিয়ম করে ভাসে শহর। জল সরতে এখনও প্রকৃতির দিকেই তাকিয়ে থাকতে হয় শহরবাসীকে।
চুঁচুড়ার খগরাজোল, ধরমপুর, মোগলটুলি এলাকায় নিকাশি ব্যবস্থার হাল খুবই খারাপ। বৃষ্টি হলেই ইষ্টনাম জপতে থাকেন মানুষজন। শহরের কেন্দ্রস্থল ঘড়ির মোড় এলাকাও নিকাশির সমস্যায় জর্জরিত। চকবাজার এলাকাও অল্প বৃষ্টিতেই জল থইথই। চুঁচুড়ার এক প্রবীণ বাসিন্দার কথায়,“রাজ্যে যে প্রাচীন পুরসভাগুলি রয়েছে হুগলি-চুঁচুড়া তার অন্যতম। কিন্তু পরিতাপের বিষয় এখনও পানীয় জল বা নিকাশির মতো প্রতিদিনের গুরুত্বপূর্ণ চাহিদাই পুরো কর্তৃপক্ষ মেটাতে পারলেন না।” প্রবীণের আপেক্ষ যে মিথ্যা নয় তার প্রমাণ, চকবাজার, রায়বাজার, কাপাসডাঙা এলাকায় আজও যথেষ্ট পানীয় জলের অভাব থেকে গিয়েছে। পানীয় জল না পেয়ে মানুষ পথ অবরোধের ঘটনাও ঘটেছে। কিন্তু সমাধান মেলেনি।
বস্তুত বাম আমলে চুঁচুড়া পুরএলাকায় নিকাশি ব্যবস্থা নিয়ে যে কাজ শুরু হয়েছিল, তা আরও বিস্তৃত হয়েছে বর্তমান পুর বোর্ডের আমলে। বিদায়ী পুরপ্রধান গৌরীকান্ত মুখোপাধ্যায় বলেন, “নিকাশি নিয়ে কিছু সমস্যা ছিল। কিন্তু ভবিষ্যতে সে সব আর থাকবে না। কেননা পুরসভার ১ থেকে ৩০ ওয়ার্ডে কেএমডিএ-র তত্ত্বাবধানে সেই কাজ চলছে। কাজ শেষ হলে আগামী বর্ষা থেকেই মানুষ তার সুফল পেতে শুরু করবেন। একইভাবে পানীয় জল নিয়েও সমস্যা আর থাকবে না। কেননা বাঁশবেড়িয়ায় জল প্রকল্প চালু হয়ে গিয়েছে। সেই জল আর কিছুদিনের মধ্যেই চলে এলে চুঁচুড়ায় জলের সমস্যা থাকবে না।”
আর শহরবাসীর এই চাওয়া-পাওয়ার জটিল অঙ্কেই ফের আর একটা পুর নির্বাচনের দোরগোড়ায় পুর কর্তৃপক্ষ। মানুষের চাহিদা পূরণের শর্তে খুব স্বাভাবিক কারণেই ভোটের অঙ্কও আবর্তিত হবে। যাঁরা এতদিন ক্ষমতায় রয়েছেন তাঁরা এখন মরিয়া, গত পাঁচ বছরে সুষ্ঠু পরিষেবার লক্ষ্যে পুরবাসীর জন্য কী করেছেন তার ফিরিস্তি দিতে। আর গত পাঁচ বছরে পুর কতৃপক্ষের ব্যর্থতা তুলে ধরতে মরিয়া বিরোধীরা। যার মধ্যে রয়েছে পানীয় জল, নিকাশিও। অবশ্য বিরোধীরা তাঁদের সমালোচনার অস্ত্রে শান দিলেও বসে নেই শাসকেরাও। ফের নিকাশি নিয়ে আশার বাণী শুনিয়েছেন তাঁরা।
ভুক্তভোগী পুরবাসী এখন শেষ পর্যন্ত এই আশ্বাসে কতটা সাড়া দেন, এখন তারই অপেক্ষা।
(চলবে)
কেমন লাগছে আমার শহর? নিজের শহর নিয়ে আরও কিছু বলার থাকলে আমাদের জানান। ই-মেল পাঠান district@abp.in-এ। subject-এ লিখুন ‘আমার শহর চুঁচুড়া’। ফেসবুকে প্রতিক্রিয়া জানান: www.facebook.com/anandabazar.abp অথবা চিঠি পাঠান ‘আমার শহর’, হাওড়া ও হুগলি বিভাগ, জেলা দফতর, আনন্দবাজার পত্রিকা, ৬ প্রফুল্ল সরকার স্ট্রিট, কলকাতা ৭০০০০১ ঠিকানায়।