ভিন্রাজ্য থেকে ইটভাটায় কাজে আসা শ্রমিকরা বঞ্চনার শিকার, অভিযোগ।
বয়স বারো কি তেরো। অপটু হাতেই ইট তৈরির কাজ করছে বাবা-মায়ের সঙ্গে। আদুর গায়ে ধুলো-মাটি মাখা। এটাই ইটভাটার চেনা ছবি। এই শিশুরা স্কুলে যায় না। কারণ, তার কোনও ব্যবস্থাই নেই। অভিযোগ, ভিন্রাজ্য থেকে ইটভাটায় কাজে আসা শ্রমিকরা বঞ্চনার শিকার। শিক্ষার অধিকার হারাচ্ছে তাঁদের ছেলেমেয়েরা।
গঙ্গা, সরস্বতী, দামোদর, রূপনারায়ণ, ইছামতী, চূর্ণীর ধারে এই ইটভাটাগুলি গড়ে উঠেছে। এক একটি ইটভাটায় দেড়শো-দু’শো পরিযায়ী শ্রমিক কাজ করেন। এঁরা মূলত ঝাড়খণ্ড, বিহারের বাসিন্দা। অক্টোবর থেকে জুন— অর্থাৎ বর্ষার আগে পর্যন্ত কাজ চলে।
হুগলিতে হাজারের বেশি ইটভাটা আছে। বিভিন্ন ইটভাটায় শিশুশ্রমিক সংক্রান্ত বিধিনিষেধের বালাই নেই। চণ্ডীতলার বনমালীপুরে একাটি ইটভাটার শ্রমিকরা জানান, মজুরি নিয়ে সমস্যা না থাকলেও ছেলেমেয়েদের পড়ার ব্যবস্থা নেই। বিহার থেকে খন্যানের ইটভাটায় কাজে আসা ভগো মারিয়া নামে মহিলা জানান, ইটভাটার চৌহদ্দিতে মাটি লেপা ইট সাজানো ছোট্ট ঘরে পরিবার নিয়ে থাকতে হয়। শ’দেড়ের শ্রমিকের জন্য বরাদ্দ দু’টি শৌচাগার। তাই মাঠই ভরসা।
মাস দেড়েক আগে হুগলিতে ইটভাটা মালিকদের নিয়ে কর্মশালা হয় জেলা শ্রম দফতরের উদ্যোগে। ন্যূনতম মজুরি, মহিলা শ্রমিকদের সমকাজে সমবেতন, সামাজিক সুরক্ষা প্রকল্পে নাম নথিভুক্ত করা, পর্যাপ্ত পানীয় জল, পরিচ্ছন্ন শৌচাগার, কমিউনিটি কিচেন যাতে থাকে প্রভৃতি বিষয়ে নজর দিতে বলা হয় ভাটা মালিকদের। ইটভাটা মালিকদের অবশ্য দাবি, শ্রমিকদের স্বাস্থ্যকর পরিবেশেই থাকতে দেওয়া হয়। চিকিৎসা বা দৈনন্দিন দিনযাপনের জন্য অন্যান্য সুযোগও দেওয়া হয়।
ইটভাটা শ্রমিকদের অধিকার সুনিশ্চিত করার দাবিতে বছর কয়েক ধরে কেন্দ্র এবং রাজ্য সরকারের কাছে আবেদন জানিয়ে আসছে চন্দননগরের ‘আইন সহায়তা কেন্দ্র’। হাওড়া, হুগলি, দুই ২৪ পরগনা এবং নদিয়ার বিভিন্ন ইটভাটায় সমীক্ষা চালায় তারা।
সংগঠনের কর্ণধার বিশ্বজিৎ মুখোপাধ্যায়ের বক্তব্য, ভিন্রাজ্যের শ্রমিকদের সামাজিক শোষণ বন্ধ করতে কেন্দ্রের সুনির্দষ্ট আইন (ইন্টার স্টেট মাইগ্র্যান্ট ওয়ার্কমেন্স অ্যাক্ট ১৯৭৯) রয়েছে। ওই আইন অনুযায়ী ‘পরিযায়ী’ শ্রমিকের ব্যাপারে শ্রম দফতরের কাছে নির্দিষ্ট তথ্য দিতে হবে ভাটা মালিককে। মাথাপিছু নির্দিষ্ট অঙ্কের টাকাও জমা রাখতে হবে। পরিচ্ছন্ন শৌচাগার, পর্যাপ্ত জল-সহ ভাল ভাবে থাকা, ন্যূনতম চিকিৎসা, ছেলেমেয়েদের পড়াশোনার ব্যবস্থা করতে হবে। কিন্তু বাস্তবে তা হয় না। অভিযোগ, অনেক ক্ষেত্রেই অস্বাস্থ্যকর পরিবেশে ঘুপচি ঘরে তাঁদের থাকতে হয়। কম টাকায় বাড়তি খাটানো, মহিলা শ্রমিকদের কম মজুরি দেওয়ার অভিযোগও রয়েছে। কিন্তু এ নিয়ে শ্রম দফতরের নজরদারি নেই বললেই চলে।
শ্রম দফতরের আধিকারিকদের বক্তব্য, শিশুশ্রমের অভিযোগ এলে ব্যবস্থা নেওয়া হয়। তবে সার্বিক নজরদারির অভাবের বিষয়টি তাঁরা মানছেন। পরিযায়ী শ্রমিকদের ছেলেমেয়েদের স্কুলে পাঠানোর ভাবনাচিন্তা চলছে বলে জেলা সর্বশিক্ষা মিশন সূত্রের দাবি। শ্রম দফতরের এক আধিকারিকের কথায়, ‘‘নিজের রাজ্য থেকে শ্রমিকের নথিপত্র আনার কথা। কিন্তু অনেকেই তা আনেন না। নথিভুক্তির কাজও সে ভাবে হয় না।’’