তেড়েফুঁড়ে নামল প্রশাসন, তবু সাড়া মিলল না মানুষের

তৎপর ছিল পুলিশ প্রশাসন। কম হলেও সকাল থেকে রাস্তায় দেখা মিলেছে বাস, অটো, টোটো, রিক্শারি। তবুও ধর্মঘটের দিনে ‘ছুটি’র অভ্যেস জারি রেখে হাওড়া ও হুগলির অধিকাংশ জায়গাতেই পথে নামার ঝুঁকি নিলেন না সাধারণ মানুষ। ধর্মঘটকে কেন্দ্র করে বৃহস্পতিবার বিক্ষিপ্ত অশান্তি হয়েছে হুগলির কয়েকটি জায়গায়। ধর্মঘট ব্যর্থ করতে শাসক দলের লোকজনের পাশাপাশি পুলিশওসব রকম ভাবে চেষ্টা করেছে বলে অভিযোগ তুলেছে বিরোধীরা। তা সত্ত্বেও ধর্মঘট সফল হয়েছে বলে তাদের দাবি।

Advertisement

নিজস্ব প্রতিবেদন

শেষ আপডেট: ০১ মে ২০১৫ ০৩:৩৩
Share:

মগরায় জিটি রোডে বিজেপির অবরোধ সরিয়ে দিচ্ছে পুলিশ।

তৎপর ছিল পুলিশ প্রশাসন। কম হলেও সকাল থেকে রাস্তায় দেখা মিলেছে বাস, অটো, টোটো, রিক্শারি। তবুও ধর্মঘটের দিনে ‘ছুটি’র অভ্যেস জারি রেখে হাওড়া ও হুগলির অধিকাংশ জায়গাতেই পথে নামার ঝুঁকি নিলেন না সাধারণ মানুষ। ধর্মঘটকে কেন্দ্র করে বৃহস্পতিবার বিক্ষিপ্ত অশান্তি হয়েছে হুগলির কয়েকটি জায়গায়। ধর্মঘট ব্যর্থ করতে শাসক দলের লোকজনের পাশাপাশি পুলিশওসব রকম ভাবে চেষ্টা করেছে বলে অভিযোগ তুলেছে বিরোধীরা। তা সত্ত্বেও ধর্মঘট সফল হয়েছে বলে তাদের দাবি।

Advertisement

আরামবাগ এবং তারকেশ্বরে কিছু বাস চলেছে। বেশ কিছু দোকানপাটও খোলা ছিল। তবে সেই তুলনায় রাস্তায় লোক ছিল না। এ দিন শ্রীরামপুর, চুঁচুড়া এবং চন্দননগর মহকুমার কোথাও রাস্তায় বাস চোখে পড়েনি। উত্তরপাড়া, কোন্নগর, শ্রীরামপুর, বৈদ্যবাটি, ভদ্রেশ্বর, চন্দননগর, চুঁচুড়া, মগরা, পাণ্ডুয়া— সর্বত্রই রাস্তাঘাট ছিল সুনসান। অধিকাংশ দোকানপাট বন্ধ ছিল। চলেনি বাস। তবে অনেক জায়গাতেই এলাকার প্রধান রাস্তায় অটো, টোটো বা রিক্‌শা ছিল। স্বাভাবিক ছিল ট্রেন চলাচলও। যদিও, সড়ক বা রেল— কোনও জায়গাতেই যাত্রী বিশেষ ছিল না।

জেলার বিভিন্ন জায়গায় ধর্মঘট নিয়ে অশান্তি এড়াতে পুলিশ দিনভর চক্কর কেটেছে। উত্তরপাড়ার মাখলায় ধর্মঘট সমর্থনকারী সিপিএমের লোকজন একটি পেট্রোল পাম্প বন্ধ করতে গেলে তৃণমূলের কর্মী-সমর্থকদের সঙ্গে তাঁদের গোলমাল বাধে। বচসা থেকে মারামারিতে দু’পক্ষের কয়েক জন জখম হন। সিপিএম নেতৃত্বের অভিযোগ, জেলা যুব তৃণমূল সভাপতি দিলীপ যাদবের নেতৃত্বে ধর্মঘট ব্যর্থ করতে মিছিল করা হচ্ছিল। মিছিল থেকেই তাদের উপর হামলা হয়। এক সিপিএম কর্মীর মাথা ফাটে। দিলীপবাবু অভিযোগ মানেননি। তাঁর প্রতিক্রিয়া, ‘‘সাধারণ মানুষ যাতে ওদের হুমকি অগ্রাহ্য করে বেরিয়ে আসতে পারেন, সে জন্য আমরা মিছিল করছিলাম ঠিকই। কিন্তু কাউকে মারধর করা হয়নি।’’

Advertisement

চণ্ডীতলার জনাইতে একটি রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যঙ্ক খোলাকে কেন্দ্র করে ধর্মঘট সমর্থনকারীদের সঙ্গে তৃণমূলের লোকজনের বচসা হয়। পুলিশ পরিস্থিতি সামাল দেয়। সিপিএমের অভিযোগ, তারকেশ্বরে তৃণমূলের তরফে বাসমালিকদের হুমকি দেওয়া হয় বাস চালানোর জন্য। সেখানকার সিপিএম নেতা স্নেহাশিস রায়ের অভিযোগ, ‘‘স্কুলে ঢুকে পুলিশ ছাত্র এবং শিক্ষকের সংখ্যা গুণে এসেছে। এমনটা আগে দেখিনি। জোর করে বাস চালানো হয়েছে। মানুষ কিন্তু পথে বেরোননি।’’ পুলিশ অভিযোগ মানেনি। সকালে বিজেপি-র লোকজন মগরায় জিটি রোড অবরোধ করেন। পুলিশ গিয়ে অবরোধ তুলে দেয়। ৮ জনকে গ্রেফতার করা হয়।

চন্দননগরের লক্ষ্মীগঞ্জ বাজারে দোকান না খোলায় আগামী ৩ দিন তাঁদের ব্যবসা বন্ধ রাখার হুমকি দিয়ে পোস্টার সাঁটার অভিযোগ উঠেছে তৃণমূলের বিরুদ্ধে। এ দিন ওই বাজারের অধিকাংশ দোকানই বন্ধ ছিল। ৫০-৬০টি দোকানে কে বা কারা ওই পোস্টার সেঁটে দিয়ে যায়। বাজার কমিটির সদস্য সুনীল পাল বলেন, ‘‘অনেক ব্যবসায়ী দূরে থাকেন। যানবাহন না চলায় তাঁরা আসতে পারেননি। কিন্তু তাই বলে এই ধরনের শাস্তিমূলক পোস্টার! এমন অভিজ্ঞতা আগে হয়নি।’’ স্থানীয় সিপিএম নেতা রমেশ তিওয়ারি বলেন, ‘‘বাম আমলে বিরোধীরা কত ধর্মঘট করেছে। শাসক দল কখনও এমন করেনি। দুষ্কৃতীদের দিয়ে তৃণমূল নেতারাই এই পোস্টার সেঁটেছেন। এ ভাবে ব্যবয়ীদের পেটে লাথি মারার চেষ্টা করছে ওরা।’’

তৃণমূল অভিযোগ মানেনি। দলের জেলা সভাপতি তপন দাশগুপ্ত বলেন, ‘‘এমন ঘটনায় আমাদের দলের কেউ যুক্ত নয়। সিপিএমের লোকজন নিজেরাই পোস্টার সেঁটে আমাদের বিরুদ্ধে কুৎসা করছে।’’

ধর্মঘট ব্যর্থ করতে রাজ্য সরকারের তরফে জেলা প্রশাসনগুলিকে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নেওয়ার নির্দেশ দেওয়া হয়েছিল। সেই নির্দেশ কার্যকর করার জন্য এ দিন পুলিশ তৎপর ছিল। তবে, প্রশাসনের তৎপরতা সত্ত্বেও কোনও জায়গাতেই সাধারণ মানুষ সে ভাবে কাজে বের হননি। জেলার সর্বত্রই সরকারি দফতর খোলা থাকলেও কর্মীরা না যাওয়ায় তা ফাঁকাই ছিল।

সূত্রের খবর, হুগলি জেলার বিভিন্ন থানার তরফে বুধবার বাসচালকদের অনুরোধ করা হয় বাস চালানোর জন্য। যদিও, এ দিন ঝুঁকি নিয়ে তাঁরা বাস চালাননি। বিভিন্ন জায়গায় স্থানীয় ভাবে সিপিএমের লোকজন দোকান-বাজার বন্ধ রাখার আর্জি জানিয়ে গিয়েছিলেন বুধবার। এ দিন আবার তৃণমূলের লোকজন রাস্তায় নামেন দোকানপাট খোলার আর্জি জানিয়ে। তৃণমূল প্রভাবিত শ্রমিক সংগঠনের তরফে অটো চালানোর আর্জি জানানো হয়েছিল।

জেলা সিপিএম সম্পাদক সুদর্শন রায়চৌধুরীর অভিযোগ, ‘‘তৃণমূল এবং ওদের পুলিশ যৌথভাবে হামলা করেছে, হুমকি দিয়েছে। ধর্মঘট ব্যর্থ করতে পুলিশ যে ভাবে ঝাঁপিয়ে পড়েছে, অভূতপূর্ব। পুলিশ নিরপেক্ষতা হারিয়েছে।’’ তাঁর দাবি ‘‘ধর্মঘট সর্বাত্মক হয়েছে।’’

আরামবাগে ধর্মঘটের সমর্থনে রাজনৈতিক দলগুলি তেমন ভাবে প্রচার করতে পারেনি। বরং শাসক দল এবং পুলিশ-প্রশাসন আলাদা ভাবে ধর্মঘট ব্যর্থ করতে প্রচার চালিয়েছিল। তা সত্ত্বেও এ দিন আরামবাগ মহকুমা জুড়ে ধর্মঘটের ভালই প্রভাব ধরা পড়েছে। শহরে প্রায় সব দোকানপাট খোলা থাকলেও খদ্দের প্রায় ছিল না। বাজার-হাট সকাল ৮টার পর সুনসান হয়ে যায়। ব্যাঙ্ক, ডাকঘর খোলা থাকলেও গ্রাহক ছিল নগণ্য। আদালতের বার অ্যাসোসিয়েশনের আইনজীবীরা কাজ করেননি। শুধু কয়েক জন সরকারি আইনজীবী হাজির ছিলেন। বিভিন্ন সরাকরি দফতরে হাজিরা ছিল আর পাঁচটা দিনের মতোই। মহকুমা শাসক প্রতুলকুমার বসু বলেন, ‘‘সরকারি সমস্ত দফতরেই ১০০ শতাংশ হাজিরা ছিল।’’ যদিও সেই সব দফতরে কাজ নিয়ে সাধারণ মানুষের ভিড় চোখে পড়েনি। অল্প সংখ্যক রুটের বাস চলেছে। তবে দূরপাল্লার বাস চলেনি। যাত্রীর অভাবে বিকেল থেকে বাসের সংখ্যা অনেক কমে যায়। অফিস ফেরৎ লোকজনকে সন্ধ্যায় বাসের জন্য দীর্ঘক্ষণ অপেক্ষা করতে হয়েছে।

শাসকদলের উদ্যোগ, পুলিশের তৎপরতা সত্ত্বেও ধর্মঘটে হাওড়ার বেশিরভাগ জায়গাতেই ভাল সাড়া মিলেছে। বেশিরভাগ জায়গাতেই বাজার, দোকানপাট বন্ধ ছিল। চলেনি বেসরকারি বাস। অন্যদিনের তুলনায় রাস্তায় সরকারি বাসও ছিল যথেষ্ট কম। বাস ছাড়া অটো, ম্যাজিক চালকদের সিংহভাগই পথে গাড়ি নামাননি। যে দু’একটি ছিল তাতেও যাত্রীর সংখ্যা ছিল হাতেগোনা। বাং-বিজেপি জেলা নেতৃত্ব এ দিনের ধর্মঘটকে স্বতঃস্ফূর্ত ও সর্বাত্মক বলে দাবি করেছেন। স্বাভাবিক ভাবেই এর উল্টো সুর শোনা গিয়েছে শাসক দলের মুখে। জেলা তৃণমূল নেতৃত্বের দাবি, সাধারণ মানুষ ধর্মঘট ব্যর্থ করে দিয়েছেন।

এ দিন বেলার দিকে ধর্মঘট ব্যর্থ করার ডাক দিয়ে বিভিন্ন এলাকার তৃণমূল নেতারা পথে নেমেছিলেন। উলুবেড়িয়ায় ধর্মঘটের বিরুদ্ধে মিছিল করে তৃণমূল। বাগনানেও দলীয় কর্মী-সমর্থকদের বাহিনী নিয়ে মিছিল করতে দেখা গিয়েছে তৃণমূল নেতাদের। তৃণমূলের মিছিল হয়। তৃণমূলের মিছিল হয়েছে ডোমজুড়ের মাকড়দহেও। ডোমজুড়ের বেগড়িতে একটি দোকান বন্ধ করাকে কেন্দ্র করে তৃণমূল এবং বিজেপির মধ্যে ঝামেলা হয়। দু’পক্ষের সমর্থকদের মধ্যে ধস্তাধস্তিও হয়। যদিও বড় ধরনের গোমমালের আগেই পরিস্থিতি সামাল দেয় পুলিশ।

ধর্মঘটের সমর্থনে এ দিন বাগনান, উলুবেড়িয়া, আমতা, শ্যামপুর, ডোমজুড়, মাকড়দহ-সহ প্রায় সর্বত্রই দোকানপাট ছিল বন্ধ। উদয়নারায়ণপুর বাসস্ট্যান্ড এলাকায় দোকানপাট খোলা থাকলেও পাঁচারুল-সহ অন্যত্র বাজার-দোকান বন্ধ রেখেছিলেন ব্যবসায়ীরা। এ ক্ষেত্রে বামেদের দাবি, যে সব এলাকায় দোকানপাট খোলা ছিল, সেখানে হুমকি দিয়ে দোকান-বাজার খোলা রাখতে বাধ্য করেছিল তৃণমূল। তৃণমূল নেতৃত্ব অবশ্য এ সব অস্বীকার করেছে।

বাগনান-আমতা, বাগনান-জয়পুর, আমতা-উলুবেড়িয়া, আমতা-সাঁকরাইল, ঝিখিরা-হাওড়া-সহ অধিকাংশ রুটের বাস চলাচল এ দিন বন্ধ ছিল। বিভিন্ন এলাকায় ছোট যানবাহন (অটো, ম্যাজিক, ট্রেকার) সংখ্যায় খুম কম হলেও চালু ছিল। সিটিসি-র বাসও নজরে পড়েছে কম। আলমপুর, আন্দুল-উল্টোডাঙা রুটের বাস সকাল থেকে বন্ধ ছিল। অভিযোগ বেলা বাড়লে তৃণমূল কার্যত হুমকি দিয়ে কিছু বাস চালু করে। দিও তৃণমূলের অবশ্য দাবি, বাসচালকদের অনুরোধ করা হয়েছিল মাত্র। যদিও সংখ্যায় বাস ছিল খুবই অল্প।

চন্দননগরে সেই বিতর্কিত পোস্টার।

তবে এ দিন চেঙ্গাইল, বাউড়িয়ার কানোরিয়া, লাডলো চটকলে কাজ করেছেন শ্রমিকেরা। বিভিন্ন স্কুল-কলেজে শিক্ষক-শিক্ষিকারা এলেও ছাত্রছাত্রীদের হাজিরার হার ছিল যথেষ্ট কম।

ধর্মঘটের ব্যাপারে সিপিএমের হাওড়া জেলা সম্পাদক বিপ্লব মজুমদার বলেন, ‘‘ধর্মঘটকে মানুষ স্বতঃস্ফূর্ত ভাবে সমর্থন করেছে। শাসকদলের সন্ত্রাস, ভোটে রিগিং ও গণতন্ত্রকে ধ্বংস করার যে চেষ্টা তার বিরুদ্ধে সাধারণ মানুষ সরব হয়ে তৃণমূলকে শিক্ষা দিয়েছেন। সেই সঙ্গে কেন্দ্রীয় সরকারের জনবিরোধী পরিবহণ নীতির বিরুদ্ধেও রুখে দাঁড়িয়েছেন তাঁরা। দুই সরকারেরই এখান থেকে শিক্ষা নেওয়া উচিত।’’

বিজেপির হাওড়ার গ্রামীণ এলাকার সভাপতিগৌতম রায়ও ধর্মঘটকে সফল বলে দাবি করে জানান, প্রমাণ হল, মানুষ তাঁদের সঙ্গে আছেন। জেলা তৃণমূল সভাপতি (গ্রামীণ) পুলক রায় বলেন, ‘‘মানুষ ধর্মঘটকে ব্যর্থ করে বিরোধীদের প্রত্যাখ্যান করেছে।’’

ছবি: তাপস ঘোষ।

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
আরও পড়ুন
Advertisement