প্রেমদাঁচ চটকলের সামনে বিক্ষোভ শ্রমিকদের। —নিজস্ব চিত্র।
কেন্দ্রীয় শ্রম দফতর নির্দেশ দিয়েছে কারখানাগুলিতে প্রতিটি শ্রমিকের ব্যাঙ্ক অ্যাকাউন্ট থাকতে হবে। তাতেই যাবে বেতনের টাকা। বুধবার হাওড়ার দু’টি চটকলে সেই নির্দেশের প্রেক্ষিতে এ মাসের বেতন নিয়ে শ্রমিকদের দু’রকম প্রতিক্রিয়া চোখে পড়ল।
ফুলেশ্বরের কানোরিয়া চটকলে কর্তৃপক্ষ শ্রমিকদের নতুন এই ব্যবস্থা সম্পর্কে বোঝাতে সক্ষম হলেও চেঙ্গাইলের প্রেমচাঁদ চটকলে তা হল না। সেখানে শ্রমিকদের একাংশ বেতন না পাওয়ায় ক্ষোভে উৎপাদন বন্ধ করে দেন।
কানোরিয়া চটকলে আজ, বৃহস্পতিবার প্রায় এক হাজার শ্রমিকের বেতন হওয়ার কথা ছিল। ঠিক ছিল, পুরনো ১০০০ ও ৫০০ টাকার নোটে বেতন দেওয়া হবে। কিন্তু ইতিমধ্যেই শ্রম দফতরের নির্দেশ এসে যাওয়ায় মিল কর্তৃপক্ষ শ্রমিকদের জানান ব্যাঙ্কে সবার অ্যাকাউন্ট না হওয়া পর্যন্ত বেতন দেওয়া যাবে না। শুধু তাই নয়, আগামী ২৫ দিনের আগে তাঁরা বেতন পাবেন না বলেও কর্তৃপক্ষ জানিয়ে দেন। এ নিয়ে শ্রমিকদের ক্ষোভের আঁচ পেয়ে বুধবার কর্তৃপক্ষ তাঁদের সঙ্গে আলোচনায় বসেন। সেখানে তাঁরা জানান, প্রত্যেক শ্রমিককে ব্যাঙ্কে অ্যাকাউন্ট খুলতে হবে। সেখানেই কর্তৃপক্ষ বেতনের টাকা দিয়ে দেবেন।
কিন্তু সমস্যা দেখা দেয়, সব শ্রমিকের ব্যাঙ্ক অ্যাকাউন্ট না থাকায়। কিছু শ্রমিকের অ্যাকাউন্ট থাকলেও তা ভিন্ন ভিন্ন ব্যাঙ্কে। শ্রমিক সংগঠন এবং চটকল কর্তৃপক্ষের মধ্যে আলোচনায় ঠিক হয়, প্রতিটি শ্রমিককে একটি নির্দিষ্ট ব্যাঙ্কে অ্যাকাউন্ট খুলে দেওয়া হবে। তাঁদের এটিএম কার্ড এবং চেক বই দেওয়া হবে। সেই অ্যাকাউন্টেই চলে যাবে বেতনের টাকা। পুরো প্রক্রিয়াটি শেষ হতে অনন্ত এক মাস সময় লাগবে। সেই সময়টুকু শ্রমিকদের ধৈর্য্য ধরে অপেক্ষা করতে হবে।
কর্তৃপক্ষের এমন প্রস্তাবে শ্রমিকদের একাংশ রাজি হলেও অনেকেই বেঁকে বসেন। তাঁরা জানান, বেতন না পেলে কাজ করবেন না। কর্তৃপক্ষ তাঁদের কাছে পরিস্থিতি ব্যাখ্যা করেন। এমনকী কর্তৃপক্ষের তরফে এ কথাও জানানো হয়, শ্রমিকেরা তাঁদের প্রস্তাব না মানলে তাঁরা চটকল বন্ধ করে দেবেন। পরিস্থিতি স্বাভাবিক হলে ফের তা চালু করবেন। এরপর সমস্ত শ্রমিক এক জোট হয়ে জানান, কর্তৃপক্ষের সঙ্গে তাঁরা পূর্ণ সহযোগিতা করবেন। এমনকী বেতন সাময়িকভাবে না পেলেও তাঁরা কাজ বন্ধ না করার প্রতিশ্রুতি দেন।
কানোরিয়া জুট সংগ্রামী শ্রমিক ইউনিয়নের নেতা লিয়াকত খান বলেন, ‘‘পরিস্থিতি আরও জটিল হয়ে পড়ত যদি কর্তৃপক্ষ কারখানা বন্ধ করে দিতেন অথবা আমরা কাজ বন্ধ করে দিতাম। অথচ এই পরিস্থিতির পিছনে শ্রমিকদের বা কারখানা কর্তৃপক্ষের কোনও দায় নেই। তাই, অপেক্ষা করা ছাড়া কোনও পথ নেই।’’
উল্লেখ্য, কেন্দ্রীয় শ্রম দফতর রাজ্যের প্রত্যেক জেলাশাসককে জানিয়ে দিয়েছে তাঁরা যেন শ্রমিকদের ব্যাঙ্ক অ্যাকাউন্ট খুলিয়ে দিতে ব্যবস্থা নেন। প্রয়োজনে কারখানা চত্বরে শিবির করে অ্যাকাউন্ট খোলা ব্যবস্থা করতে বলা হয়েছে।
হাওড়া জেলা শ্রম দফতর এবং জেলা লিড ব্যাঙ্ক-এর তরফে জানানো হয়, বিভিন্ন কারখানা কর্তৃপক্ষের সঙ্গে এ ব্যাপারে আলোচনা চলছে। শ্রমিকদের নামের তালিকা পেলেই তাঁদের ব্যাঙ্ক অ্যাকাউন্ট খুলে দেওয়া হবে। জেলা শ্রম দফতর সূত্রে জানানো হয়েছে, কানোরিয়া চটকলের শ্রমিকদের অ্যাকাউন্ট খোলার জন্য সংলগ্ন একটি রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাঙ্কের সঙ্গে কথা হয়েছে। খুব শীঘ্র ওই ব্যাঙ্কের আধিকারিকেরা কানোরিয়ায় গিয়ে শ্রমিকদের অ্যাকাউন্ট খোলানোর ব্যবস্থা করবেন।
ব্যাঙ্কে বেতন নিয়ে কী বলছেন শ্রমিকেরা?
এখনই বেতন না পাওয়ার খবরে রীতিমত হতাশ কানোরিয়ার শ্রমিক সেখ সরাবুদ্দিন, তৈয়ব আলি লস্কর। তাঁদের কথায়, ‘‘এমন সমস্যায় এর আগে পড়িনি। কিন্তু কী বা করার আছে। বুঝতে পারছি মিল কর্তৃপক্ষ অসহায়। কাজ বন্ধ করেও লাভ নেই। অগত্যা মাসখানেক পেটে গামছা বেঁধেই কাজ করতে হবে।’’ মিলের এক পদস্থ কর্তা বলেন, ‘‘শ্রমিকদের বলেছি আমরা অসহায়। নতুন একটা ব্যবস্থা চালু হচ্ছে। তাতে সময় লাগবে। ওঁরা আমাদের কথা বুঝেছেন।’’
তবে কানোরিয়ায় মিল কর্তৃপক্ষের কথা শ্রমিকেরা শুনলেও চেঙ্গাইলের প্রেমচাঁদ চটকলে বেতন না পেয়ে কাজ বন্ধ করে দেন শ্রমিকদের একাংশ। এই চটকলে প্রায় চার হাজার শ্রমিক কাজ করেন। বুধবার সকাল ১১ টায় বি শিফট-এর শ্রমিকদের কাজে যোগ দেওয়ার কথা ছিল। কিন্তু বেতনের দাবিতে তাঁরা কাজ বন্ধ করে দেন। প্রতি মাসের ৮ এবং ২৩ তারিখে বেতন হয়। শ্রমিকেরা জানান, তাঁরা শেষবার বেতন পেয়েছেন ৮ নভেম্বর। কিন্তু ২৩ নভেম্বরের বেতন এখনও পাননি।
কর্তৃপক্ষের বক্তব্য, কেন্দ্রীয় শ্রম দফতরের নির্দেশ মেনে এখানেও তাঁরা ব্যাঙ্কের মাধ্যমে শ্রমিকদের বেতন দেওয়ার পরিকল্পনা করেছেন। শ্রমিকদের পাল্টা অভিযোগ, কর্তৃপক্ষের কাছে তাঁরা অ্যাকাউন্ট নম্বর জমা দিয়েছেন। অনেকের নতুন ব্যাঙ্ক অ্যাকাউন্ট খুলে দেওয়া হয়েছে। তাঁরা এটিএম কার্ডও পেয়েছেন। কিন্তু অ্যাকাউন্টে টাকা আসেনি। বিক্ষুব্ধ শ্রমিকদের অভিযোগ, কর্তৃপক্ষ কবে তাঁদের ব্যাঙ্ক অ্যাকাউন্টে টাকা দেবেন সে বিষয়ে সুনির্দিষ্ট আশ্বাস দেননি। তাঁদের সংসার চালাতে দুর্বিষহ অবস্থায় পড়তে হচ্ছে। মিল কর্তৃপক্ষের যুক্তি, নতুন ব্যবস্থা চালু করতে একটু সময় লাগছে। দু’একদিনের মধ্যে শ্রমিকদের অ্যাকাউন্ট-এ বেতন চলে যাবে।