’৮২-তেও নথিভুক্তিতে জমা আধার

ভূমি দফতরে মৃতও বিক্রি করেন জমি!

এ যেন দালালদের স্বর্গরাজ্য! হুগলির ভূমি দফতরের অফিসগুলিতে দালালদের খবরদারি বেড়েই চলেছে। তাদের অঙ্গুলিহেলনে কী না হয়! জমি সংক্রান্ত বিষয়ে তারাই যেন শেষ কথা।ভূমি দফতরের নথিতে নিজের পারিবারিক জমির ক্ষেত্রে চণ্ডীতলার সনকা গ্রামের জয়দেব বিশ্বাসের অস্তিত্বই নেই। ফলে, তাঁর জমি বিক্রি হয়ে গিয়েছে অনায়াসেই।

Advertisement

প্রকাশ পাল 

চুঁচুড়া শেষ আপডেট: ১৯ সেপ্টেম্বর ২০১৯ ০১:৪০
Share:

প্রতীকী ছবি।

মৃত মানুষ দিব্যি বেঁচে ওঠেন এখানে! তবে, কাগজে-কলমে।

Advertisement

চণ্ডীতলা-২ ব্লকের চিকরণ্ডের বাসিন্দা যুগল দাস ১৯৬৫ সালের ২৪ মে মাসে মারা গিয়েছেন। সেখানকারই কিশোরী দাস মারা যান ১৯৬৪ সালের ৪ ফেব্রুয়ারি। অথচ, ব্লক ভূমি দফতরের নথি বলছে, তাঁরা জমি বিক্রি করেছেন ১৯৮২ সালে। অর্থাৎ, মৃত্যুর প্রায় দেড় যুগ পরে! শুধু তা-ই নয়। ’৮২ সালের আধার কার্ডের প্রতিলিপিও জমা পড়ে গিয়েছে সেখানে। যখন আধার কার্ডের অস্তিত্বই ছিল না দেশের কোথাও ।

ভূমি দফতরের নথিতে নিজের পারিবারিক জমির ক্ষেত্রে চণ্ডীতলার সনকা গ্রামের জয়দেব বিশ্বাসের অস্তিত্বই নেই। ফলে, তাঁর জমি বিক্রি হয়ে গিয়েছে অনায়াসেই। বছর খানেক আগে পৈতৃক জমি দেখতে গিয়ে বাধা পেতে হয় বিফল দাসকে। এর পরেই তিনি আকাশ থেকে পড়েন। জানতে পারেন, তিনিই নাকি জমি বেঁচে দিয়েছেন! ভূমি দফতরের কাগজপত্র সে কথাই বলছে। গত কয়েক বছরে এমনই নানা ঘটনায় জেলার বিভিন্ন জায়গায় জমি জালিয়াতির কথা সামনে এসেছে। প্রকৃত মালিকের অজ্ঞাতে বিঘের পর বিঘে জমি চুপিসারে চলে যাচ্ছে জমি-মাফিয়াদের গ্রাসে।

Advertisement

অন্যের জমি হাতানো থেকে জলাশয়ের চরিত্র বদল করে বাস্তুজমি হিসেবে দেখানো—হুগলিতে ভূমি দফতরের অফিসগুলিতে কিছুই অসম্ভব ‌নয়। দালালদের কাজে লাগিয়ে জমি-মাফিয়ারা জাল নথিপত্র তৈরি করে, ভুয়ো লোককে মালিক সাজিয়ে জমি-জালিয়াতি চালাচ্ছে বলে মানছেন সেখানকার কর্মীদের একাংশই।

গত কয়েক বছরে জমি-জালিয়াতির অনেক অভিযোগ জমা পড়েছে পুলিশ-প্রশাসনের দফতরে। আদালতে মামলাও হয়েছে। দুষ্টচক্রে যুক্ত অভিযোগে ধড়পাকড়ও করেছে পুলিশ। কিন্তু ধৃতেরা নেহাতই চুনোপুঁটি বলে অভিযোগ। ফলে, রাঘব-বোয়ালরা অধরাই। ভূমি দফতরের এক কর্তা বলেন, ‘‘নির্দিষ্ট অভিযোগ পেলে সেই মোতাবেক আইনি ব্যবস্থা নেওয়া হয়।’’

কিন্তু অনেক ক্ষেত্রেই দেখা যায়, জমি বেহাত হয়ে যাওয়ার কথা জানতে পেরে শেষে থানা-পুলিশ বা আদালতে না-দৌড়ে জমির মালিক জমি-কারিবারিদের সঙ্গে সমঝোতা করতে বাধ্য হন। শ্রীরামপুর আদালতের আইনজীবী রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর বলেন, ‘‘বিভিন্ন মামলায় দেখেছি, ভূমি দফতরে বড়সড় চক্র সক্রিয়। তাদের মাধ্যমেই এই অনিয়ম হয়।’’

কয়েক বছর আগে ডানকুনির মোল্লাবেড়ের একটি পরিবার তাদের জমির একাংশ বিক্রির মনস্থ করেন। কিন্তু সরকারি দফতরে গিয়ে তাঁরা জানতে পারেন, জমি বিক্রি হয়ে গিয়েছে! নথি ঘেঁটে দেখা যায়, মালিক সেজে অন্য এক জ‌ন জমি বিক্রি করেছে। তাকে শনাক্ত করেছেন অপর এক জন। যে ব্যক্তি জমি বিক্রি করেছেন বলে দেখানো হয়েছে, তিনি দীর্ঘদিন ধরে নিখোঁজ ছিলেন। চণ্ডীতলা ব্লকের একটি পঞ্চায়েতের প্রাক্তন এক উপপ্রধানের পরিবারও জমি-জালিয়াতির শিকার হয়। অভিযোগ, দুষ্টচক্রের এক জন উপপ্রধানের বাবা সেজে গিয়েছিল। যে সময়ে জমি বিক্রি হচ্ছে, প্রাক্তন ওই উপপ্রধানের বাবা তাঁর পঁয়ত্রিশ বছর আগে মারা গিয়েছেন।

সংশ্লিষ্ট সরকারি আধিকারিকরা মানছেন, ভূমি দফতর ঘুঘুর বাসা। এক শ্রেণির কর্মীর মদতেই দালালরাজ এখানে জাঁকিয়ে বসেছে। দালালদের বিরুদ্ধে এক শ্রেণির আধিকারিক রুখে দাঁড়ানোর চেষ্টা করলেও তাঁদেরই শেষপর্যন্ত কোণঠাসা হতে হয়, এমন নজিরও রয়েছে।

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
আরও পড়ুন
Advertisement