(বাঁ দিকে) ছেলের প্রচারে দেওয়াল লিখনে বাবা সালেম খান। আনিস খান (ডান দিকে)। নিজস্ব চিত্র।
হাওড়ার নিহত ছাত্র নেতা আনিস খানের দাদা সামসুদ্দিন খানকে পঞ্চায়েত ভোটে প্রার্থী করল সিপিএম। রবিবার তাঁর সমর্থনে দেওয়ালে সিপিএমের নির্বাচনী প্রতীক কাস্তে-হাতুড়ি-তারা আঁকতে দেখা গেল বাবা সালেম খানকে। কুশবেড়িয়া পঞ্চায়েত সমিতির ৪২ নম্বর আসনে সামসুদ্দিনকে প্রার্থী করা হয়েছে। এ ব্যাপারে সামসুদ্দিনের সঙ্গে যোগাযোগের চেষ্টা করা হয়। কিন্তু তাঁকে ফোনে পাওয়া যায়নি। তবে তাঁর দাদা সাবির খান আনন্দবাজার অনলাইনকে বলেন, ‘‘আনিস প্রতিবাদী চরিত্র। সব সময় অপশাসনের বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়াত ও। শাসক দলের চোখরাঙানি উপেক্ষা করেই লড়াইয়ে নেমেছিল। কিন্তু তার মাসুল গুনতে হয়েছে ওকে। পরিকল্পিত ভাবে হত্যা করা হয়েছে আনিসকে। আনিস একটা সুস্থ সমাজ গড়ার স্বপ্ন দেখত। যে কারণে ওকে খুন হতে হয়েছে! আনিসের সেই স্বপ্নপূরণের লক্ষ্যেই রাজনীতিতে আসার সিদ্ধান্ত।’’
গত বছর ১৮ ফেব্রুয়ারি আনিসকে তাঁর বাড়িতে খুনের অভিযোগ ওঠে পুলিশের বিরুদ্ধে। সেই ঘটনাকে কেন্দ্র করে উত্তাল হয়েছিল রাজ্য রাজনীতি। আনিসের মৃত্যুর ঘটনার পর থেকেই আমতা থানায় লাগাতার বিক্ষোভ কর্মসূচি নিতে দেখা গিয়েছিল বাম ছাত্রযুবদের। সংগঠনের রাজ্য নেতা-নেত্রীরা পালা করে সেখানে প্রতিবাদে নেতৃত্ব দেন। দোষীদের শাস্তির দাবিতে পথে নেমে বিক্ষোভ দেখাতে গিয়ে গ্রেফতার হয়েছিলেন ডিওয়াইএফআই-এর রাজ্য সম্পাদক মিনাক্ষী মুখোপাধ্যায়-সহ ১৬ জন। সেই সময় জেলবন্দি নেতা-নেত্রীদের মুক্তির দাবিতে বামেদের পাশে দাঁড়াতে দেখা গিয়েছিল সালেমকেও। মীনাক্ষী গ্রেফতার হওয়ার পর তাঁর বাবা, মা-ও পশ্চিম বর্ধমান থেকে এসে আনিসের পরিবারের সঙ্গে দেখা করে সহমর্মিতা জানিয়েছিলেন। ছাত্রনেতার বাড়িতে গিয়েছিলেন সিপিএমের যুব ও ছাত্র নেতা অভয় মুখোপাধ্যায়, সৃজন ভট্টাচার্য, প্রতীক-উর রহমানেরা। স্থানীয়েরা জানাচ্ছেন, আনিসের মৃত্যুর পর থেকে তাঁর পরিবারের সঙ্গে যোগাযোগ চলতেন সিপিএম নেতারা। গত বছর ইদে আনিসের বাড়িতে থেকেছিলেন সিপিএমের রাজ্য সম্পাদক মহম্মদ সেলিম।
আনিসের মৃত্যুর ঘটনার প্রতিবাদে আন্দোলনের রাশ মূলত বামেদের হাতেই ছিল। রাজ্য পুলিশের তদন্তের গতি ধীর, এই অভিযোগ তুলে লাগাতার কর্মসূচি নিতে দেখা গিয়েছে বাম ছাত্রযুবদের। সিপিএমের মিছিলে গিয়েছিলেন সালেমও। ছেলের প্রার্থী হওয়া নিয়ে তিনি বলেন, ‘‘আনিস হত্যার বিরুদ্ধে আমাদের লড়াই জারি থাকবে। যারা আনিসকে খুন করেছে, তাদের বিরুদ্ধে লড়তেই আমার বড় ছেলে ভোটের রাজনীতিতে নেমেছে। ও যাতে ভোটে জিততে পারে, তার জন্য সর্বতো ভাবে সাহায্য করব।’’
তৃণমূল জমানার আনিসকাণ্ডের সঙ্গে অনেকেই বাম আমলে রিজ়ওয়ানুর রহমানের অস্বাভাবিক মৃত্যুর ঘটনার মিল খুঁজে পেয়েছিলেন সেই সময়। রিজ়ওয়ানুরের মৃত্যুর পিছনে পুলিশের অতিসক্রিয়তার অভিযোগ উঠেছিল এবং তাকে কেন্দ্র করেই উত্তাল হয়েছিল বঙ্গসমাজের বড় অংশ। ঠিক যে রকমটা দেখা গিয়েছে আনিসকাণ্ডেও। ঘটনাচক্রে, রিজ়ওয়ানুরের দাদা রুকবানুর রহমানকেও বিধানসভা নির্বাচনে প্রার্থী করেছিল শাসক তৃণমূল। ভোটে জিতে বিধায়ক হয়েছেন রুকবানুর। একই ভাবে, নন্দীগ্রামকাণ্ডের শহিদ শেখ ইমদাদুলের মা ফিরোজা বিবিকেও বিধানসভায় প্রার্থী করেছিলেন মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। ২০০৯ সালের উপনির্বাচনের পর ২০১১ সালের ভোটেও নন্দীগ্রাম থেকেই বিধায়ক হয়েছিলেন ফিরোজা। রাজ্য-রাজনীতিতে তাঁর পরিচয় ‘নন্দীগ্রামের মা’ হিসাবেই। সেই ‘দস্তুর’ মেনেই নদিয়ার কৃষ্ণগঞ্জে খুন হয়ে যাওয়া তৃণমূল বিধায়ক সত্যজিৎ বিশ্বাসের স্ত্রী রূপালিকে ২০১৯ সালের লোকসভা নির্বাচনে রানাঘাট আসনে প্রার্থী করেছিল তৃণমূল। যদিও বিজেপির জগন্নাথ সরকারের কাছে হেরে যান রূপালি। এ বার আনিসের দাদাকে পঞ্চায়েত ভোটে প্রার্থী করে সেই পথেই হাঁটল সিপিএম।
আনিসের দাদা সাবির অবশ্য জানিয়েছেন, প্রথমে তাঁরা সক্রিয় রাজনীতিতে আসার পক্ষপাতী ছিলেন না। কিন্তু সিপিএম নেতাদের আশ্বাস পেয়ে আনিসহত্যার বিরুদ্ধে নতুন করে লড়াইয়ের ডাক দিতেই ভোটের ময়দানে নামার সিদ্ধান্ত নিয়েছেন তাঁরা। একই কথা বলছেন সিপিএমের হাওড়া জেলা সম্পাদক দিলীপ ঘোষও। তিনি বলেন, ‘‘আমরা প্রথম থেকেই আনিসের পরিবারের সঙ্গে আছি। এই পরিবার যাতে সুবিচার পায়, তার জন্য আমরা লড়াই করে চলেছি। ওঁরাও সেটা বুঝেছেন। সেই কারণেই সিপিএমের প্রার্থী হতে রাজি হয়েছেন সামসুদ্দিন খান। আমরা আশাবাদী, উনি জিতবেন।’’
পঞ্চায়েতে আনিসের দাদার প্রার্থী হওয়া নিয়ে হাওড়া গ্রামীণের তৃণমূল সবাপতি অরুণাভ সেন বলেন, ‘‘সিপিএমের মুখে অপশাসনের কথা মানায় না। সব চেয়ে বেশি অপশাসন দেখা গিয়েছে ওদের জমানাতেই। আর আনিস খানের মৃত্যুর সঙ্গে তৃণমূলের কোনও সম্পর্ক নেই। তৃণমূলকে জড়িয়ে দেওয়ার চেষ্টা হচ্ছে। নির্বাচনে যে কেউ প্রার্থী হতেই পারেন। কিন্তু মানুষ উন্নয়নের পক্ষেই ভোট দেবেন।’’