সম্রাজ্ঞী নূরজাহান (বাঁ দিকে)। চিকনের কাজ করা কাপড়ের অংশ (ডান দিকে)। নিজস্ব চিত্র।
চিকন হচ্ছে কাপড়ের উপর ছিদ্রবহুল ফুলতোলা নকশা। চিকন বলতেই মাথায় আসে লখনউ চিকনের কাজ। দেশজোড়া তার খ্যাতি। কিন্তু সেই চিকন আসলে চুঁচুড়ার অদূরে বাবনানের শিল্পীদের আবিষ্কার।
একসময়ে হুগলির তুলোর কদর ছিল গোটা বিশ্বে। ধনেখালিতে তৈরি হত উৎকৃষ্ট মানের কাপড়। সেই কাপড়ের উপর চিকনের কাজ করে চাহিদা আরও বাড়িয়ে তোলা হত। এ ছাড়াও হত কাট-আউট কাজ, ঝাঁজের কাজ, যা সাধারণত ব্যবহার করা হতো টেবল ক্লথ, বেড কভার প্রভৃতি কাজে। অর্থাৎ, ওই শিল্পকর্ম ফুটে উঠত আচ্ছাদনী বস্ত্রে। চুঁচুড়ার পশ্চিমে বাবনান বলে একটি প্রাচীন গ্রাম শুধু ‘চিকনের গ্রাম’ নামেই বিখ্যাত ছিল। এখনও সেই গ্রামে চিকনের কাজ হয়। তবে, খুব কম পরিমাণে।
এই চিকনের কাজের ভক্ত ছিলেন মেহেরউন্নিসা। তিনি ছিলেন বর্ধমানের জায়গিরদার শের আফগানের স্ত্রী। শের আফগানের মৃত্যুর পর কন্যা-সহ মেহেরউন্নিসাকে মোগল সাম্রাজ্যের রাজধানী দিল্লিতে নিয়ে যাওয়া হয়। সময়টা ১৬০৭ খ্রিস্টাব্দ। তাঁর হাত ধরেই চিকনের কাজ পৌঁছে যায় দিল্লিতে। এই মেহেরউন্নিসাকে পরে বিয়ে করেন সম্রাট জাহাঙ্গির। মেহেরউন্নিসার নাম হয় নূরজাহান। সম্রাজ্ঞীর কাছ থেকে উপহার পেয়ে চিকনের কাজ ক্রমে লখনউয়ের নবাব এবং তাঁদের বিবিদের প্রিয় হয়ে ওঠে। চিকনের কাজ ছড়িয়ে পড়ে গোটা লখনউতে।
এর বেশ কিছুকাল পরে ব্রিটিশ সরকার এবং তাদের বণিকেরা বাংলার শিল্পকে ধ্বংস করে দেয়। যা ছিল উর্বর ফসলের সোনার বাংলা, তাকে ক্রমে বাণিজ্যের বাংলা করে তোলে তারা। একই সঙ্গে ধ্বংস করে দেয় তাঁতশিল্পকেও। ক্রমশ দেশটাকে কাঁচামালের আড়তে পরিণত করা হয়। বস্ত্র, মিহি কাপড়— সব বন্ধ করে এখান থেকে শুধু তুলো রফতানি হত। আর সেই তুলো থেকে ব্রিটেনে বস্ত্র তৈরি করে এখানেই নিয়ে এসে বিক্রি করত।
টিকে থাকতে না পেরে বাবনানে ক্রমে চিকনের কাজ বন্ধ হয়ে যায়। ছড়িয়ে পড়ে লখনউ শহরে। খ্যাতিও বাড়ে। মুছে যায় বাবনানের নাম।
তথ্য ও ছবি: দেবাশিস মুখোপাধ্যায় (প্রাবন্ধিক)