প্রায়ই আগুন লেগে চুঁচুড়ার ভাগাড় থেকে দূষিত ধোঁয়া ছড়াচ্ছে শহরের বিভিন্ন এলাকায় (বাঁ দিকে) । শ্বাসকষ্টে আক্রান্ত খুদেও (ডান দিকে)। ছবি: তাপস ঘোষ এবং নিজস্ব চিত্র।
আবর্জনার স্তূপ জমতে জমতে পাহাড়ের চেহারা নিয়েছে। দুর্গন্ধে টেকা দায়। তার উপরে রাত হলেই সেই স্তূপে আগুন জ্বলতে দেখা যাচ্ছে। বিষাক্ত ধোঁয়ায় আকাশ ঢাকছে। ছড়াচ্ছে দূষণ।
চুঁচুড়ার সুকান্তনগরের ওই ভাগাড়ের যন্ত্রণা নতুন নয়। কিন্তু ধোঁয়া-দূষণ থেকে কবে মুক্তি মিলবে, জানেন না আশপাশের এলাকার বাসিন্দারা। তাঁদের অনেকেরই দাবি, ওই ধোঁয়ার জন্য অনেকে শ্বাসকষ্টজনিত সমস্যায় ভুগছেন। ছোটরাও ছাড় পাচ্ছে না। কিন্তু দেখার কেউ নেই। ক্ষোভ প্রকাশ করেছেন পরিবেশপ্রেমীরা।
দেড়শো বছর অতিক্রম করা হুগলি-চুঁচুড়া পুরসভার জন্মলগ্ন থেকেই সুকান্তনগরে রয়েছে ভাগাড়টি। তখন জনবসতি কম ছিল। তাই ৬.১ একর জমিতে গড়ে ওঠা সেই ভাগাড়ে শহরের বর্জ্য ফেলা হত। এখন জনসংখ্যা বহুগুণ বেড়েছে। আশাপাশ এলাকায় বসতি গড়ে উঠছে। ভাগাড়ের একটা বড় অংশও দখল হয়ে গিয়েছে। ফলে, ছোট হয়ে যাওয়া সেই ভাগাড়ে বেড়েছে বর্জ্যের পরিমাণ।
বর্তমানে শুধু পুর এলাকার নয়, কোদালিয়া-১ পঞ্চায়েতের সিংহভাগ এলাকার বর্জ্যও ওই ভাগাড়ে ফেলা হয়। এলাকাবাসীর একাংশের দাবি, ভাগাড়ে রাতে আগুন লাগিয়ে দেওয়া হয়। ধোঁয়া উড়তে থাকে দিনেরবেলাতেও। আগুন ভয়াবহ রূপ নিলে ডাকা হয় দমকলকে। না হলে স্থানীয়েরাই নেভানোর কাজে হাত লাগান। বিষাক্ত কার্বন-ডাই অক্সাইডের প্রভাবে স্থানীয় বসন্তবাগান এলাকার ছোট থেকে বড়— অনেকেই শ্বাসকষ্টের সমস্যায় ভুগছেন বলে জানিয়েছেন। বছর তিনেক আগে এক বৃদ্ধের এই দূষণের কারণেই মৃত্যু হয়েছে বলে এলাকাবাসীর দাবি।
ভাগাড় লাগোয়া বসন্তবাগানের বাসিন্দার সবচেয়ে বেশি সমস্যায় পড়লেও রবীন্দ্রনগর, সুকান্তনগরের পাশাপাশি কয়েকশো মিটার দূরে খাদিনা মোড়েও বিষ-ধোঁয়ার প্রভাব পড়ছে।
পুর পারিষদ (স্বাস্থ্য) জয়দেব অধিকারীর আশ্বাস, ‘‘আর মাত্র বছর চারেক। তারপর এই ভাগাড়েই ছেলেমেয়েরা খেলবে, পিকনিক করবে। পচনশীল ও অপচনশীল বর্জ্য আলাদা করার কাজ শুরু হয়েছে। ভবিষ্যতে বর্জ্য দিয়ে সার তৈরির কাজ শুরু হলে সমস্যা অনেকটাই মিটে যাবে।’’ প্রায় একই দাবি করেছেন সদর মহকুমা প্রশাসনের এক কর্তাও।
ফলে, সমস্যা যে দ্রুত মিটবে, এমন কোনও আশ্বাস মিলছে না। বর্তমান পরিস্থিতিতে চার বছর টিকে থাকাই দুষ্কর ব্যপার বলে মনে করছেন ভুক্তভোগীরা। তাঁদের মধ্যে বসন্তবাগানের সোমা দেবনাথের বড় ছেলে সৌরভের বয়স নয়। বছর তিনেক আগে থেকেই সে শ্বাসকষ্টজনিত রোগে আক্রান্ত। মাত্র পাঁচ মাস বয়সের ছোট ছেলে সৌভিককে আবার রোজ ‘ইনহেলার’ নিতে হয়। সোমার বক্তব্য, ‘‘দুর্গন্ধ তো ছিলই। তার সঙ্গে বছর কয়েক ধরে ধোঁয়ার সমস্যা যুক্ত হয়েছে। নেহাত ঘরবাড়ি ছেড়ে যেতে পারছি না। না হলে এখানে কেউ থাকে নাকি!’’ এই এলাকার সমীর রায়ের আট বছরের ছেলে সুদীপ্তও শ্বাসকষ্টে আক্রান্ত। বছর পঞ্চান্নর লক্ষ্মী রায়েরও একই সমস্যা।
পরিবেশকর্মী বিশ্বজিৎ মুখোপাধ্যায়ের ক্ষোভ, ‘‘মাস কয়েক আগেই পরিবেশ আদালত রাজ্যকে বর্জ্য ব্যবস্থাপনার জন্য কয়েক হাজার কোটি টাকা বরাদ্দের নির্দেশ দিয়েছে। কিন্তু রাজ্য বাজেটে সেই নির্দেশ মানা হল না। ফলে, ভবিষ্যতে ভয়াবহ সমস্যার সম্মুখীন হতে পারে রাজ্য। কারণ, আগুন লাগার পর বর্জ্যেথাকা প্লাস্টিক পুড়ে বিষাক্তডায়োসিন গ্যাস বাতাসে ছড়াচ্ছে। যা ক্যানসারে আক্রান্ত হতে অব্যর্থ ভূমিকা পালন করে।’’