ভাঙা হচ্ছে কলেজের ভবন। নিজস্ব চিত্র
‘বিপজ্জনক’ হয়ে পড়ায় সংস্কারের জন্য হুগলি মহসিন কলেজের ঐতিহ্যবাহী মূল ভবন (বঙ্কিম ভবন) ভাঙা হচ্ছে। কাউকে কিছু না জানিয়ে অধ্যক্ষ পুরুষোত্তম প্রামাণিক ওই সিদ্ধান্ত নিয়েছেন, এই অভিযোগে সরব হয়েছেন প্রাক্তনীরা। তাঁরা ওই ভবনের ফরাসি স্থাপত্যশৈলী বজায় রেখে সংস্কারের দাবি তুলেছেন। অভিযোগ মানেননি অধ্যক্ষ। তবে, মঙ্গলবার প্রাক্তনীদের সঙ্গে বৈঠকের পরে তিনি জানিয়েছেন, যথাসম্ভব পুরনো শৈলী বজায় রেখেই সংস্কার করা হবে।
কলেজ সূত্রে জানা গিয়েছে, ওই ভবনের দোতলার ঘর থেকে চাঙড় খসে পড়ছিল। বিষয়টি পূর্ত দফতরকে জানানো হয়। ওই দফতরের ইঞ্জিনিয়াররা সরেজমিনে পরিদর্শন করে গোটা ভবনে দোতলার ছাদ ভেঙে নতুন করে তৈরির পরামর্শ দেন। কয়েকটি ঘরের উপর থেকে লিন্টেল পর্যন্ত সংস্কারেরকথাও বলা হয়েছে। সেই মতো পূর্ত দফতর দেড় কোটি টাকার বাজেট নির্ধারণ করে। সেই বাজেটকলেজের পক্ষ থেকে রাজ্য সরকারের কাছে পাঠানো হয়। অনুমোদন মিলেছে। মোট পাঁচ দফায় টাকা আসবে। প্রথম দফায় ৩০ লক্ষ টাকা চলে আসায় ছাদ ভাঙার কাজ শুরু করেছে পূর্ত দফতর।
জেলা পূর্ত দফতরের (সামাজিক বিভাগ) এগজ়িকিউটিভ ইঞ্জিনিয়ার জয়দেব সিকদার এ নিয়ে কোনও মন্তব্য করতে রাজি হননি। কলেজের সভাপতি তথা চুঁচুড়ার বিধায়ক অসিত মজুমদার বলেন, ‘‘ছাদ ভাঙার বিষয়ে পূর্ত দফতর নিজেই সিদ্ধান্ত নিয়েছে। আমি গোটা বিষয়টি জানি। এ দিন আলোচনাসভাতেও আমার থাকার কথা ছিল। দলীয় কর্মসূচির জন্য যেতে পারিনি। ভবনের মূল কাঠামোতে পুরনো শৈলীই বজায় থাকবে।’’ অধ্যক্ষ বলেন, ‘‘ভেবেছিলাম গড়ার আগে প্রাক্তনীদের জানালেই হবে। সংস্কারের সময় যথাসম্ভব পুরনো শৈলী বজায় রাখার চেষ্টা করা হবে।’’
কলেজে লাগানো সরকারি ফলক বলছে, ১৮০৪-১৮০৫ সালে ওই ভবন নির্মাণ করেন ফরাসি জেনারেল পেরন। পরে চুঁচুড়ার জমিদার জগমোহন শীল এই ভবন কিনে নেন। ১৮৩৬ সালের পয়লা অগস্ট থেকে এই ভবনেই ‘হুগলি মহসিন কলেজ'-এর পথচলা শুরু হয়।
স্থানীয় ইতিহাস নিয়ে চর্চা করেন এ শহরের বাসিন্দা সপ্তর্ষি বন্দ্যোপাধ্যায়। তিনি জানান, হাজি মহম্মদ মহসিন ওয়েলফেয়ার ট্রাস্ট পরে ওই ভবনটি জমিদারের থেকে কেনে। মহম্মদ মহসিনের নামেই কলেজের নামকরণ হয়। সাহিত্যসম্রাটবঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়, বিপ্লবী কানাইলাল দত্ত, দ্বারকানাথ মিত্র, সৈয়দ আমির আলি প্রমুখ বিশিষ্টজন এই কলেজের ছাত্র ছিলেন।
৫০০০ বর্গফুটের ওই ভবনে অধ্যক্ষের দফতর, শিক্ষকদের ঘর, ছাত্রীদের কমন রুম এবং কলা বিভাগের আটটি বিষয়ের শ্রেণিকক্ষ-সহ প্রায় ২৫টি ঘর রয়েছে। বর্তমানে দোতলার ছাদ ভাঙা চলছে। বর্তমানে কলা বিভাগের ক্লাস চলছে একতলায়। ওই ছাত্রছাত্রীদের এরপরে প্রয়োজনে অন্য শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে নিয়ে গিয়ে সাময়িক ভাবে পড়ানো হতে পারে বলে কলেজ সূত্রের খবর। এ জন্য হুগলি মাদ্রাসা এবং অধ্যাপক জ্যোতিষচন্দ্র ঘোষ বালিকা বিদ্যালয় পরিদর্শন করা হয়েছে বলেঅধ্যক্ষ জানান।
এই ভবনেই রয়েছে প্রাক্তনী সংগঠনের অফিস। প্রাক্তন ছাত্র পলাশ দত্ত বলেন, ‘‘বর্তমানে গোটা বিশ্ব ঐতিহ্য বাঁচাতে একজোট হচ্ছে। কিন্তু আমাদের কিছু না জানিয়ে দু’শো বছরের প্রাচীন ঐতিহ্যশালী ভবন ভাঙা শুরু হল। এটা মানা যায় না।’’ কলেজের আর এক প্রাক্তনী দিলীপ দাস বলেন, ‘‘করোনাকালে এমনিতেই পড়াশোনা বন্ধ ছিল। এখন ভবন সংস্কারের নামে আবার পড়াশোনা বন্ধ হলে ছাত্রছাত্রীরা সমস্যায় পড়বেন।’’ এ দিনের বৈঠকে ছিলেন স্থানীয় পুরপ্রধান অমিত রায়ও। তিনিও এই কলেজের প্রাক্তনী। তিনি বলেন, ‘‘কলেজ কর্তৃপক্ষের এমন সিদ্ধান্তের কথা আমারও জানা ছিল না। ভবনের স্থাপত্যশৈলী বজায় রেখেই যাতে সংস্কার করা হয় সে বিষয়ে আমরা সরকারের কাছে আবেদন জানাব।’’