নতুন জীবন পেয়ে ওই ব্যক্তি হাতজোড় করে বলতে থাকেন, ‘‘সত্যি বলছি, আর কোনও দিন মদ খাব না (নেশা করব না)।’’ এই কথা যখন তিনি বার বার আওড়াচ্ছিলেন আর ঈশ্বরকে ধন্যবাদ দিচ্ছিলেন, তাঁর স্ত্রী ততই ফুঁপিয়ে কেঁদে উঠছিলেন।
হাতজোড় করে প্রতিজ্ঞা, আর নেশা করবেন না তিনি। প্রাণে বেঁচে এ কথাই বললেন তরুণ মুখী। নিজস্ব চিত্র।
রবিবার সকাল ১০টা। অফিস টাইম। চুঁচুড়া স্টেশনে একটু দেরিতে ঢুকেছিল ট্রেন। ফলে ট্রেন ধরার জন্য ভিড়ও হয়েছিল যথেষ্ট। ট্রেন ঢুকতেই হুড়োহুড়ি পড়ে গেল ওঠার জন্য। এই হুড়োহুড়ির মধ্যেই ধাক্কায় টাল সামলাতে না পেরে প্ল্যাটফর্ম এবং ট্রেনের ফাঁক গলে পড়ে যান এক ব্যক্তি। তত ক্ষণে ট্রেন চলতে শুরু করেছিল। স্বামীকে পড়ে যেতে দেখে চলন্ত ট্রেন থেকে লাফ মারেন স্ত্রী। এক ব্যক্তির নীচে পড়ে যাওয়া, আর তার পর পরই এক মহিলার ট্রেন থেকে ঝাঁপ, এমন আকস্মিকতায় প্ল্যাটফর্মে দাঁড়িয়ে থাকা লোকজনের মধ্যে হইহই পড়ে যায়। চিৎকার শুনে দৌড়ে আসেন এক জিআরপি কর্মী। স্বামীকে বাঁচাতে গিয়ে মহিলা তত ক্ষণে প্রায় ট্রেনের তলায় ঢুকে যাচ্ছিলেন। তাঁকে কোনওক্রমে টেনে সরিয়ে আনেন ওই জিআরপি কর্মী।
কিন্তু লোকটা যে প্ল্যাটফর্ম ও ট্রেনের ফাঁক গলে পড়ে গেল, তাঁর কী হল? এই আতঙ্ক এবং কৌতূহল তখন তুঙ্গে। মহিলাও তত ক্ষণে স্বামীর জন্য কান্নাকাটি শুরু করে দিয়েছেন। প্ল্যাটফর্মে থাকা যাত্রী এবং স্থানীয়রা ধরেই নিয়েছিলেন যে ওই ব্যক্তি আর বেঁচে নেই। কিন্তু ট্রেন স্টেশন ছেড়ে বেরোতেই দেখা গেল, বেগুনি রঙা জামা পরে লাইন থেকে ওঠার চেষ্টা করছেন ওই ব্যক্তি। সকলে যেন ধড়ে প্রাণ ফিরে পান। একই সঙ্গে হতভম্বও হয়ে যান, এ কী করে সম্ভব হল! যে ভাবে তিনি ফাঁক গলে পড়ে গিয়েছিলেন তাতে তো না বাঁচারই কথা। কিন্তু কথায় আছে না, রাখে হরি মারে কে! এই ব্যক্তির ক্ষেত্রেও তা-ই হয়েছে।
তাঁকে স্টেশনে তুলে বসানো হয়। নতুন জীবন পেয়ে ওই ব্যক্তি হাতজোড় করে বলতে থাকেন, ‘‘সত্যি বলছি, আর কোনও দিন মদ খাব না (নেশা করব না)।’’ এই কথা যখন তিনি বার বার আওড়াচ্ছিলেন আর ঈশ্বরকে ধন্যবাদ দিচ্ছিলেন, তাঁর স্ত্রী ততই ফুঁপিয়ে কেঁদে উঠছিলেন।
জানা গিয়েছে, ওই ব্যক্তির নাম তরুণ মুখী। ঝাড়গ্রামের বাসিন্দা। পেশায় ক্ষেতমজুর। এক মাস আগে তাঁদের ২২ জনের একটি দল হুগলির পোলবায় আলু তোলার কাজে এসেছিলেন। সেই দলটি চুঁচুড়া স্টেশন থেকে হাওড়ায় যাওয়ার জন্য ট্রেন ধরতে এসেছিলেন। এমনিতেই ট্রেন দেরিতে ঢুকেছিলে। ১০টা ১২ মিনিটের ডাউন বর্ধমান লোকাল। ভিড়ও হয়েছিল প্রচুর। দলের সকলে ঠেলাঠেলি করে উঠে গেলেও ভিড়ের ধাক্কায় লাইনে পড়ে যান তরুণ। তাঁকে পড়ে যেতে দেখে চলন্ত ট্রেন থেকে লাফ মারেন স্ত্রী ললিতা। তরুণ জানান, ট্রেনে ওঠার আগে একটু নেশা করেছিলেন। কিন্তু সেই নেশাই যে তাঁর প্রাণ কেড়ে নিত! বেঁচে ফিরে তাই বার বার বলেছেন, “আর কোনও দিন নেশা করব না।” নেশা ছেড়ে দেবেন বলে স্ত্রীর কাছে প্রতিজ্ঞাও করেন তিনি। তরুণ আরও বলেন, “পড়ে গিয়ে প্রথমে ভেবেছিলাম আমি আর বাঁচব না। কিন্তু নিজের শরীরটাকে কোনওরকমে গুটিয়ে নিই। যাতে ধাক্কা না লাগে। ঈশ্বরের অশেষ কৃপা যে প্রাণে বেঁচেছি।”