সর্ষে থেকে তেল তৈরি করে ব্যবসা চলে ছোট তেলকলের। কিন্তু সেখানেও এখন মন্দার ছায়া। নিজস্ব চিত্র।
দু’বছর আগে যে সর্ষের তেলের দাম তিন অঙ্কে পৌঁছয়নি, বর্তমানে তা ডবল সেঞ্চুরি হাঁকিয়েছে। দামের এই ঊর্ধ্বগতি কোথায় গিয়ে থামবে, ব্যবসায়ীরা বুঝে উঠতে পারছেন না। এই পরিস্থিতিতে দু’পয়সা বাড়তি লাভ দূরঅস্ত্, হুগলির অনেক তেলকল চলছে খুঁড়িয়ে। গত কয়েক বছরে কিছু তেলকল বন্ধও হয়ে গিয়েছে। পাততাড়ি গুটিয়ে মালিকেরা অন্য ব্যবসায় নেমেছেন। কেননা, সর্ষে চাষ কমেছে কৃষিপ্রধান এই জেলায়।
গোঘাট থানা মোড়ের একটি তেলকলের মালিক সত্যসুন্দর দে জানান, পাঁচ-ছ’বছর আগে পর্যন্ত প্রতিদিন গড়ে ১ থেকে ২ কুইন্টাল সর্ষে ভাঙতেন। দু’জন কর্মী ছিলেন। এখন ৪-৫ দিন অন্তর ৪০-৪৫ কেজি সর্ষে জমা হলে ভাঙেন। অর্থাৎ, মাসে ৬-৮ দিনের বেশি কাজ হয় না। বাধ্য হয়ে কিছু গমও ভাঙছেন তিনি। তাঁর কথায়, ‘‘ব্যবসা ওঠার মুখে। এখন কর্মী আছেন এক জন। তাঁর বেতনের পয়সাই উঠছে না। অন্য ব্যবসা করব, ভাবছি।’’
একই পরিস্থিতি আরামবাগ শহরের গৌরহাটি মোড়ের তেলকল মালিক দিলীপ দে’র। তিনি জানান, চার-পাঁচ দিন অন্তর এক কুইন্টাল তিল এবং সর্ষে জমা হলে তবে কল চালু করেন। আরামবাগের মিয়াঁপাড়া জাহাঙ্গির চৌধুরীর তেলকলের এক সময় রমরমা ছিল। লোকসানের বহরে বছর তিনেক আগে তেলকল তুলে ব্যাগ, চা-বিস্কুটের ব্যবসা শুরু করেছেন। গোঘাটের দশঘড়ার প্রভাকর নন্দী, বেলেপাড়ার কানাই ঘোষ, কামারপুকুর চটির অভয় নন্দীরাও তেলকল তুলে দিয়েছেন। কামারপুকুর সিনেমাতলায় গোবিন্দ রায়ের তেলকল রয়েছে। তিনি জানান, ১০-১২ দিন অন্তর ৪০-৫০ কেজি সর্ষে জমা হলে তিনি আর ছেলে মিলে ভেঙে দেন। তাতে সংসার চলে না। সে জন্য ১০০ দিনের প্রকল্পে কাজ করছেন।
জেলায় যে সব তেলকল টিকে আছে বা ভাল চলছে, তার মালিকেরা সর্ষে আনান ভিন্ রাজ্য থেকে। তাঁরা জানান, গত দু’বছরে সর্ষের দাম আকাশছোঁয়া হয়েছে। স্বাভাবিক কারণেই তেলের দামও সাধারণ মানুষের নাগালের বাইরে চলে গিয়েছে। শেওড়াফুলির এক তেলকল মালিক জানান, দু’বছর আগে তিনি সর্ষে কিনতেন ৩৫-৪০ টাকা কেজি দরে। এখন তা আড়াই গুণ বেশি দামে কিনতে হচ্ছে।
বৈঁচীর একটি তেলকলের মালিক ইন্দ্রনাথ সাধুখাঁ জানান, চার বছর আগে এক লিটার তেল ৪০-৫০ টাকা কেজি দরে বিক্রি করেছেন। গত বছর বেচেছেন ৮৫-৯৫ টাকায়। এখন তার দাম ১৯০-২০০ টাকা। তিনি বলেন, ‘‘হরিয়ানা, পঞ্জাব, রাজস্থান থেকে আমাদের সর্ষে আসে। এখন সর্ষে ঠিকমতো আসছে না। দামও প্রচুর। তার ফলেই এই অবস্থা। স্থানীয় এলাকা থেকে সর্ষে পেলে চাষিরাও লাভবান হতেন, আমাদেরও মুনাফা হত। দামও আয়ত্তে থাকত।’’
হুগলির চাষিরা মূলত বাড়িতে তেলের প্রয়োজন মেটাতেই সর্ষে চাষ করেন। অতিরিক্ত সর্ষে বেচে দেন। কিন্তু সেই পরিমাণ যৎসামান্য। তাঁদের বক্তব্য, আলু এবং সর্ষে একই সময়ের ফসল। সর্ষে চাষে লাভ খুবই কম। সে জন্য তাঁরা আলুই বেছে নেন। সর্ষে চাষে কৃষকদের উৎসাহিত করার চেষ্টা করছে কৃষি দফতর। তাতে কতটা কাজ হয়, তার উপরেই সর্ষের ফলন বৃদ্ধি নির্ভর করছে। ফলন বাড়লে তেলকলগুলি ফের চাঙ্গা হবে বলে মনে করছেন কারবারিরা।
ছবি: সঞ্জীব ঘোষ ও সুশান্ত সরকার