Historcal Places

গঙ্গাপাড়ের শহরগুলি যেন‘মিনি ইউরোপ’

ষোড়শ শতাব্দীর মধ্যভাগ থেকে  সরস্বতী  নদীর নাব্যতা হ্রাস পেলে প্রথমে পর্তুগিজ নাবিকের দল হুগলিতে ঘাঁটি গড়তে উদ্যোগী হয়। সাল ১৫৪০ থেকে ১৬৩২।

Advertisement

দেবাশিস মুখোপাধ্যায়

শেষ আপডেট: ০৬ ফেব্রুয়ারি ২০২৩ ০৭:১৬
Share:

চুঁচুড়ার আর্মেনিয় স্যেন্ট জন গির্জা। ছবি সংগৃহীত।

কলকাতা থেকে ৪০ কিলোমিটারের মধ্যেই হুগলির ব্যান্ডেল থেকে কোন্নগরের মধ্যবর্তী অঞ্চলে ছড়িয়ে আছে বাংলার এক অনন্য ঐতিহ্য। যা কলকাতার চেয়েও প্রাচীন এবং গৌরবময়। দু’টি দিন সময় পেলেই আমাদের সোনার বাংলায় কারা এসে বাণিজ্য করে গিয়েছিল, কুঠি গড়েছিল, তার এক ইতিহাসের সাক্ষী হতে পারেন যে কেউ।

Advertisement

ফসল ও কুটির শিল্পের লোভে এই এলাকার মধ্যে বিদেশি বণিকের দল বাণিজ্য করতে এসে গড়ে তুলেছিল কুঠি। পরে নিজেদের স্বার্থসিদ্ধির জন্য জমি কিনে জমিদারি গড়ে তোলে। বণিকের মানদণ্ড ছেড়ে তাদের হাতে উঠে আসে শাসনের রাজদণ্ড।

একদা ইউরোপের আট থেকে দশটি দেশ এখানে বাণিজ্য করতে আসে। ষোড়শ শতাব্দীর মধ্যভাগ থেকে সরস্বতী নদীর নাব্যতা হ্রাস পেলে প্রথমে পর্তুগিজ নাবিকের দল হুগলিতে ঘাঁটি গড়তে উদ্যোগী হয়। সাল ১৫৪০ থেকে ১৬৩২। প্রায় ১০০ বছর বঙ্গদেশের বুকে চলে পর্তুগিজদের শোষণ, অত্যাচার, লাম্পট্য আর ধর্মান্তরিতকরণ। বাঙালির দৈনন্দিন জীবনে কী ভাবে ঢুকে পড়েছিল পর্তুগিজরা, তার প্রমাণ এখনও রয়ে গিয়েছে বাংলা ভাষায় ব্যবহৃত পর্তুগিজ শব্দে। আয়া, আলমারি, বাসন, আলপিন, বোতাম, বালতি, গির্জা, সাবান, গুদাম, কামরা— এ সবই পর্তুগিজদের অবদান। পেঁপে, লেবু, তামাক, পেয়ারা, কপি, আতা, আনারসও তারাই নিয়ে এসেছিল এদেশে। ১৫৯৯ সালে হুগলিতেই পর্তুগিজরা নির্মাণ করেন দেশের প্রাচীনতম গির্জাটি।

Advertisement

এদের পাশাপাশি মুঘলদের অনুমতি পেয়ে হুগলিতে বিনা শুল্কে বাণিজ্য আর কুঠি নির্মাণ করে ইংরেজরা। এখানকার কোম্পানির শেষ এজেন্ট ছিলেন জোব চার্নক। এখান থেকেই তিনি চলে গিয়ে ঘাঁটি গড়েন সুতানুটিতে। হুগলির দক্ষিণে, চুঁচুড়ায় কুঠি গড়ে ওলন্দাজ অর্থাৎ নেদারল্যান্ডসের নাবিকেরা। ১৬৮৭-তে এরা দুর্গ গড়ে তার মধ্যেই শহর বানিয়ে নেয়। সেই দুর্গের কোনও চিহ্ন না থাকলেও সেখানকার ভাঙা ইট-কাঠ দিয়েই তৈরি হয়েছিল সেনা-ব্যারাক। সেটিই বর্তমানে চুঁচুড়া আদালত ভবন। যে কেউ দেখে আসতে পারেন।

ওই বাড়িটিকে এক সময়ে বলা হত ‘এশিয়ার দীর্ঘতম বাড়ি’। ১৭৪২-এ নির্মিত গির্জাটির চিহ্ন আর না থাকলেও আশপাশে দেখা যায় ডাচ স্থাপত্যশৈলীর নানা নিদর্শন। তাদেরই তৈরি একটি মিনার দেখা যায় জিটি রোডের পাশে, ‘সাত বিবির গোর’। এই নির্মাণকে কেন্দ্র করেই উপন্যাস লিখেছিলেন রাসকিন বন্ড। রাজনৈতিক কারণে ডাচেরা শহরটি ইংরেজদের হাতে দিয়ে দেশে ফিরে যায়। আর্মেনিয়রাও যে এই শহরে থাকতেন তার প্রমাণ ১৬৯৫ সালে তৈরি সেন্ট জনের গির্জা। এটিই পশ্চিমবঙ্গে দ্বিতীয় এবং ভারতে তৃতীয় প্রাচীনতম গির্জা বলে পরিচিত।

১৬৭৩-৭৪ সাল নাগাদ দুপ্লেসি নামে এক ফরাসি বণিক চুঁচুড়ার দক্ষিণে বোড় কিসানপুরে জমি কিনে বাস করতে শুরু করেন। এই বসতবাড়ির দক্ষিণে চন্দননগরে গড়ে উঠেছিল ফরাসি বাণিজ্য কেন্দ্র। ক্রমে দুর্গ গড়ে তার পাশে পরিকল্পনামাফিক সুন্দর করে নিজেদের বাসস্থান অঞ্চলটি তৈরি করে ফেলে ফরাসিরা। স্ট্র্যান্ড, প্রশাসক আবাস, সেন্ট জোসেফ চ্যাপেল, প্যারি হোটেল (এখন আদালত ভবন) প্রভৃতি ফরাসি আমলের বহু স্মারক গোটা শহরে এখনও ছড়িয়ে আছে।

বেলজিয়ান বা ফ্লেমিশ বণিকেরা কুঠি নির্মাণের অনুমতি পায় ভদ্রেশ্বরে। সেই কুঠির কোনও চিহ্নই পাওয়া যায় না। তেমনই জার্মান বা প্রুশিয়ান ও অস্ট্রিয়ানদের মিলিত ‘অস্টেড কোম্পানি’ নির্মিত কুঠি ছিল গোন্দলপাড়ার দক্ষিণে। সেই কুঠিরও কোনও অবশিষ্ট নেই। কিন্তু গঙ্গার ধারে বাণিজ্যদ্রব্য রাখার জন্য বড় বড় গুদামঘর এখনও প্রাচীন ইতিহাসকে স্মরণ করায়। ভদ্রেশ্বর ও চাঁপদানির মধ্যবর্তী গৌরহাটিতে ছিল ফরাসিদের একটি ছিটমহল। সেই আমলের একটি থানা এখনও দেখা যায়।

ডেনমার্কের বণিকেরা প্রথমে কুঠির জন্যে বেছে নিয়েছিল চন্দননগরের দক্ষিণ-পূর্ব দিকের গোন্দলপাড়া অঞ্চলের ছোট একটি জায়গা। পরে ১৭৫৫-তে নবাবের অনুমতি পেয়ে শেওড়াফুলির রাজার কাছ থেকে ৬০ বিঘা জমি ইজারা নিয়ে চলে আসে শ্রীরামপুরে। এই শহরের সঙ্গে জড়িয়ে আছে বাংলা মুদ্রণের সূচনা-পর্ব। মার্শম্যান, ওয়ার্ড আর উইলিয়াম কেরির নাম। তাঁদের বাসভবনটি এখনও সযত্নে রক্ষিত। ডেনমার্ক সরকারের বদান্যতায় তাদের নির্মিত ট্যাভার্ন, সেন্ট ওলাফ গির্জা আধুনিক পদ্ধতিতে সংরক্ষণকরা হয়েছে।

এই সব কিছুই ইতিহাসের পরিপ্রেক্ষিতে অনন্য নজির। যার মধ্যে রয়ে গিয়েছে পর্যটন শিল্পের বিকাশের এক উজ্জ্বল সম্ভাবনা। দরকার শুধু সুসংহত করে গড়ে তোলা।

লেখক একজন প্রাবন্ধিক

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
আরও পড়ুন
Advertisement