কাজে ব্যস্ত চন্দননগরের আলোকশিল্পীরা। ছবি: তাপস ঘোষ।
করোনা-পর্বে মুখ থুবড়ে পড়েছিল চন্দননগরের আলোর বাজার। একাধিক আলোকশিল্পীকে আনাজ বা মাছ বেচে পেট চালাতে হয়েছে। পরিস্থিতি অনেকটাই বদলেছে। নতুন করে ঘুরে দাঁড়াচ্ছে আলোর ব্যবসা। কিন্তু কলকাতার পুজোয় চন্দননগরের সাবেক আলো ক্রমশ কমছে। কারণ, দাম মিলছে না বলে দাবি আলোকশিল্পীদের। তাই আবেগ থাকলেও কলকাতামুখো হতে চাইছে না তাঁদের অনেকেই। আলো
নিয়ে পাড়ি জমাচ্ছেন অন্য জেলা বা ভিন্ রাজ্যে।
এক সময়ে কলেজ স্কোয়ার, মানিকতলা চৌমাথা-সহ কলকাতার বহু বড় পুজো আলোয় সাজিয়েছেন চন্দননগরের বর্ষীয়ান আলোকশিল্পী দীপকচন্দ্র ঘোষ ওরফে তাপস। এ বার ডাক এলেও সাড়া দেননি। বেশি টাকার বরাত পেয়েছেন আলিপুরদুয়ার, দার্জিলিং, এমনকি ত্রিপুরা থেকেও। তাপসের বক্তব্য, কলকাতা বরাবরই আলোর নতুন নতুন কাজ দেখতে চায়। কিন্তু গত কয়েক বছর ধরে সেখানে অনেক পুজো প্রায় পনেরো দিন ধরে হচ্ছে। কাজেই আলোকশিল্পীদের খরচ বাড়ছে। অথচ বারোয়ারিগুলি সেই অতিরিক্ত টাকা দিতে নারাজ। তাই ইচ্ছা থাকলেও কলকাতায় কাজ করা সম্ভব হচ্ছে না। চন্দননগরের নাম ভাঁড়িয়ে অন্য জায়গার কিছু ব্যবসায়ী বর্তমানে কলকাতায় কাজ করছেন বলেও তাঁর অভিযোগ।
কলকাতায় কাজ করে পকেট ভরছে না, দাবি আর এক শিল্পী কাশীনাথ দাসেরও। তিনি বলেন, ‘‘কলকাতা নয়, বাইরে কাজ করেই বেশি রোজগার হচ্ছে। তাই অনেকেই আর কলকাতায় যেতে চাইছেন না।’’ আর এক প্রবীণ শিল্পীর পর্যবেক্ষণ, ‘‘এলইডি আসায় কাজ অনেকটাই সহজ হয়েছে। চন্দননগরের কাজ একটু দেখে নিলেই সড়গড় হয়ে যাচ্ছেন অন্য কারিগররা।’’
চন্দননগরে মোট আলোকশিল্পীর সংখ্যা দু’শোরও বেশি। তার মধ্যে চন্দননগর ‘লাইট ওনার্স অ্যাসোসিয়েশন’-এর আওতায় রয়েছেন ৩৪ জন। শিল্পীদের অনেকেই জানাচ্ছেন, কলকাতায় ষষ্ঠী থেকে দশমী যে আলোর মূল্য ছিল ৭ লক্ষ, এখন প্রায় পনেরো দিনে তার জন্য ৪-৫ লক্ষ টাকার বেশি মিলছে না।
সূত্রের খবর, কলকাতার বড়বাজার থেকে রেডিমেড এলইডি কিনে নিচ্ছেন সেখানকার আলো ব্যবসায়ীরা। এরপর চন্দননগরে কাজ শেখা কারিগরদের একাংশকে দিয়ে সেই আলো বোর্ডে সাজিয়ে পুজোর বাজার জমাচ্ছেন। সেই কারিগরদের বেশিরভাগই অতিমারির সময় চন্দননগর ছেড়েছিলেন।
কলকাতার গড়িয়ার একটি নামজাদা পুজো কমিটির এক সদস্যের ব্যাখ্যা, পুজোয় আনন্দকেই সবাই প্রাধান্য দেয়। আয়োজনের ক্ষেত্রে বাজেট মাথায় রাখতে হয়। তাই ‘ব্র্যান্ডের’ পিছনে দৌড়নো বন্ধ করতে হচ্ছে। তাঁর সংযোজন, ‘‘কম টাকায় একই জাঁকজমক থাকলে, কে-ই বা ব্র্যান্ডের দিকে ছুটবে!’’
চন্দননগর লাইট ওনার্স অ্যাসোসিয়েশনের সদস্য অসীমকুমার দে’র অভিযোগ, ব্যবসায়িক কারণে এখানকার বড় শিল্পীদের টেক্কা দিতে ছোট শিল্পীরা ঠিকাদার মারফত আলো ভাড়া দেওয়া শুরু করেছিলেন। তাতে শিল্পীদের আলো নিয়ে যাওয়া থেকে ‘সেট’ করা পর্যন্ত মাথাব্যথা থাকত না। ফলে কম দরে ঠিকাদারদের আলো ভাড়া দেওয়া হত। বর্তমানে তার জেরেই বারোয়ারিগুলি কম টাকা দিতে চাইছে।
অসীম মনে করেন, বর্তমানে প্রতিযোগিতার বাজারে চন্দননগরের আলোকশিল্পকে টিকে থাকতে গেলে সব দিক থেকে আরও আধুনিক হতে হবে। নতুন ভাবনারও দরকার। গুজরাত, হায়দরাবাদ, রাজস্থান প্রভৃতি জায়গা থেকে এ রাজ্যে আসা অনেকে এখন আলোর ব্যবসায় টাকা ঢালছেন। আধুনিক হতে না পারলে চন্দননগরের আলোর ব্যবসা ভিন্ রাজ্যের ওই সব ব্যবসায়ীদের কুক্ষিগত হয়ে যাবে বলে তাঁর আশঙ্কা।